Sunday 28 January 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ। কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে। এমনি কাঁচাই..... কিংবা ভেজে বেগুন- সহযোগে। যকৃতের পক্ষে ভারী উপকার। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক...। দাঁত ভালো থাকে। কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হন। বলেন- নিমের হাওয়া ভাল, থাক, কেটো না। কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না। আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে। শান দিয়ে বাধিয়েও দেয় কেউ- সে আর এক আবর্জনা। হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বলে উঠলো, বাঃ কি সুন্দর পাতাগুলো.....কি রূপ। থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার....এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ! খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল। কবিরাজ নয়, কবি। নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে। ওদের বাড়ীর গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মী বউটার ঠিক এই দশা।"



(নিমগাছ বনফুল)


সম্পাদকীয় দপ্তর-
হিন্দোল ভট্টাচার্য  মণিশংকর বিশ্বাস  শ্যামল ভট্টাচার্য  বেবী সাউ

স্মরণ



সতর্কীকরণ

প্রার্থনা চলবে না 
হাঁচি নিষিদ্ধ।

থুতু ফেলা,
তারিফ করাহাঁটু গেড়ে বসা,

পুজো করাগর্জন-তর্জনকাশিনাক ঝাড়া
এখানে সবকিছুই নিষিদ্ধ।
এই এলাকায় ঘুমোনো চলবে না
টিকা দেয়াগুজগুজ-ফুসফুসবাতিল করে দেওয়া
একসঙ্গে সুর ভাঁজা,পালিয়ে যাওয়া
একে ধরা-ওকে ধরা
-সব এখানে হারাম
দৌঁড়ানোর নিয়ম একেবারেই নেই

ধূমপান নিষেধ। চোদা বারণ

নিকানোর পাররা ১৯১৪-২০১৮)

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য


ধারাবাহিক গদ্য




'আমাকে কি খুব উদ্ভট দেখায়, বন্ধু?'

প্রশ্নটা করেই একদম চুপ করে যায় গোপাল। চুপ করে থাকে সেলুনের বাকি
সবাইও। কাগজে পড়ছিলাম তখন একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর।
রোববারের সেলুনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ওর পুরনো 'আমি'-টি তার
ভিতরের সমস্ত রোমাঞ্চ নিয়ে নতুন 'আমি'-র রহস্যজগতের উদ্দেশেই প্রশ্নটা
ছুঁড়ে দেয় যেন। তারপর হেসে ফেলে। সে হাসির দিকে তাকালে মনে হয়, মুখের
কলকবজাগুলো ফট করে খুলে গিয়ে একফোঁটা নরক বেরিয়ে এল। গোটা মুখে ফুটো
ফুটো দাগ। ওখানে ভালো করে বীজ পুঁতে দিলে কয়েকদিন বাদে পুরুষ্টু ধানের
গোছা বেরিয়ে আসবে। জটিলতর খাঁচার মধ্যে ঢুকে থাকা দুর্বোধ্য তেলতেলে
মুখটি নিয়ে গোপাল হাসতে থাকে। ওকে কেউই তেমন পাত্তা দেয় না। বহু পুরনো
এবং বেঢপ বুটজুতো পরে ধুলো উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় রাস্তা দিয়ে। ও কী করে,
তা কেউ জানে না। কোথায় থাকে, তাও জানে না কেউ। সারাদিন এই সেলুন এবং তার সংলগ্ন দোকানগুলোতে ঘোরাফেরা করে। পচা জলের পাঁকের মধ্যে কাঁকড়া বা মাছ যেমনভাবে বজবজ
  শব্দ করে বুদবুদ তোলে, অনেকটা ওরকমই একটি শব্দ ও করার চেষ্টা করে মুখ দিয়ে। দেখলে বোঝা যায়, ওর কিছু নেই। কোনও প্রত্যাশা
নেই। কোনও অভাবিত আনন্দ নেই। কোনও প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা নেই। যা আছে, তা
কেবল এই প্রশ্নটিই। প্রতি রোববার সেলুনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই
প্রশ্নটি সে আসলে যেন নিজেকেই করে। তারপর হাসে। গোপাল হাসে। ক্ষিতি, অপ,
তেজও হাসে। মানুষ কেবল হাসে না। তারা জানে, ও অপ্রকৃতিস্থ। এমন সব কথা সে
বলতে থাকে যার কোনও অর্থ নেই এবং আবেগের দ্বারা প্রবলভাবে স্পর্শিত না
হলে সেই সব কথায় এমনকি একটা সময় পর হাস্যোদ্রেকও হয় না।

'আমাকে কি খুব উদ্ভট দেখায় বন্ধু?'- প্রশ্নটা সে আরেকবার করে। এই
প্রশ্নটি কেন করে সে? তার মতোই কোনও অপ্রকৃতিস্থর সঙ্গে দেখা করতে যায়
কি আজ? প্রতি রোববার? নাকি, নিজেকেই বলে এমনি? দুপুরের সেলুনের শীত শীত
আলোর মধ্যে তা ক্রমাগত পাক খেতে থাকে তারপর। জ্বলো বাতাসের মতো ঘুরে ঘুরে আসে। হাতুড়ির মতো আঘাত করে ঠাস ঠাস করে। প্রতি রোববার সেলুনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করার পর গোপালের মুখ দেখলে মনে হয়, ওর ভিতরটা বোঝাই হয়ে ছিল বহুদিন। বোঝার ভারে রক্ত এসে গিয়েছিল মুখে।
  প্রশ্নটা
করার সময় যেন শিরা ছিঁড়ে পড়ে এবং নিজেকে সে একটু একটু করে ভারমুক্ত
করে, খালাস করে দেয় সমস্ত বোঝা।

প্রশ্নটি একসময় ঝট করে বেরিয়ে যায় সেলুন থেকে। লরির চাকায় ধুলো ওঠে
রাস্তায়। সেই ধুলোর মধ্যে নিরুত্তেজ প্রশ্নটিকে নিয়ে মিশতে মিশতে আরও
একটি বড়ো ধুলোর দিকে চলে যায় গোপাল।

খবরের কাগজ থেকে অল্প মুখ তুলে আড়চোখে তাকিয়ে তারপর দেখি, আমার পাশে
বসে থাকা আরও তিনজন মৃত মানুষও ভিন্ন কাগজ থেকে একই খবর পড়ে চলেছে মন দিয়ে।



অর‌‌িজিৎ চক্রবর্তী








অন্নাদ

সংরক্ষক হ‌িসেব‌ে লবণ‌ের ব্যাবহার য‌েদ‌িন শ‌িখলাম
পরিধির মধ্য‌ে ঢুক‌ে পড়ল ভগবান
শ‌োনো যুগাদ্যাদ‌েবী,
দ্র‌োণ পাত্র‌ে প্রল‌োভন স্বাভাব‌িক



শূন্য

আহ্ন‌িকগত‌ির  গল্পগ‌ুলি আজ থাক।ত‌োমাক‌ে ওগুল‌ো পরের চ‌িঠিত‌ে লিখব।তুম‌ি শুধু  জ‌েনে নাও কলকাতার‌  তুলনায় দার্জ‌‌িলিং,-এর উচ্চতা সমুদ্রতল থ‌‌েকে বেশ‌ি। এবং চিন‌ে নাও পৃথ‌িবীর প্রতারণাগুল‌ি...


দিন দ‌িন অামরাও আর ঠকত‌ে ভাল‌ো লাগ‌েনা। ভূপৃষ্ঠ  থ‌‌েকে যত  নীচ‌ে যাওয়া যায় তত শূন্যতাই  আঁকড়‌ে ধরো  আমি ওলনদড়‌ির স‌োজাসুজ‌ি জীবন ব‌িনীত হয়‌ে গেছ‌ে বুঝ‌ি !


একদ‌িন হ‌ৈহৈ কামিনীগাছ‌ে ফুল  ফ‌োটে।

শ্যামল ভট্টাচার্য




অপলক দৃশ্য 


সকাল বেলায় চোখ খুলে যে আলো সে দেখতে পেল তাতে বুঝতে পারলো , যে আশ্চর্য ব্যাপারটা চলছিল এতদিন , তা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। সম্ভবত তাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো , তাঁর এই ফিকে হয়ে যাওয়াটা ... শেষ কয়েকমাস বিষয়টা যেন একটা সাংঘাতিক গতি পেয়েছিলো। যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় মানুষেরা তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখছিলো না , যেভাবে সেমত উপেক্ষা মানতে না পেরে সে আগ্রাসী হওয়ার চেষ্টা করেছে যখনই, সবাই চমকে উঠছিল , তখনই সে নিজের ফিকে হয়ে যাওয়ার গতি সম্পর্কে সন্দেহাতীত সচেতন হয়ে উঠতে পারছিলো। আর আজকের চারপাশের আলো প্রত্যাশিতরকমেরই আলাদা। অর্থাৎ সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কারো কাছ থেকে কোন প্রত্যক্ষ মনোযোগ তাঁর যেন আর আশা করার নেই। সে বিস্মিত হল না, রেগে গেল না , কোনরকম আবেগই চিৎকার হয়ে উঠল না তাঁর মুখে। আসলে এর জন্যে তাঁর একটা প্রস্তুতি ছিলোই। সে উঠে পড়লো। স্নানঘরে গেল। যথাযথ স্নান ঠিক হল না যেন। ফিরে এসে পোশাক পরল। আয়নার সামনে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টাও করলো না। কারণ সে নিজেকেও দেখতে পাবে না এটা সে জানে। যেমন জানে, তাঁর কোন কিছুই আর ঠিক যথাযথ হয় না তাঁর। সে খেয়ে নিল সামান্য কিছু। তাঁর খিদেও পেয়েছিলো খুব। যাদের কারণ ছাড়াই খুব খিদে পায় তাঁরা কি আসলে আবেগের দিক থেকে ক্ষুদার্ত হয়ে থাকে ... কোথাও কোন আবেগের সাড়া পায় না বলে এত খাদ্যপ্রিয়তা ... যেন ওই খাবারগুলিই প্রকৃত গ্রহন করছে প্রাণের সবটুকু আনন্দ নিয়ে তাঁকে। তাঁর আর খেতে ইচ্ছে করলো না। সে ঠিক এভাবে বাঁচতে চায় না। সে এবার তাঁর কর্মস্থলের জন্যে বের হয়ে গেল। সবকিছুই খুব মসৃণভাবে হয়ে চলেছে। ব্যাপারটা সে জানে, একেবারেই অবাক হওয়ার মত নয়। সবকিছু এভাবেই হয়ে থাকে বলে , হয়ে চলেছে। সবকিছুই রীতিনীতি প্রথা আর অভ্যাসের ব্যাপার। সব মানুষের অভ্যেসগত জীবন যাপনের যে ছক তা যেহেতু একে অপরকে জড়িয়ে থাকে , ভাবনাশূন্যভাবেই, সে-ও তাঁর ভিতরে আছে। তাঁকে নিয়ে অভ্যেসগত যে জীবনযাপন ... সেটা তো চলছে। নিজেদের অভ্যেস বিঘ্নিত হোক , এটা কেউই চায় না। এটা যে তাঁকে লক্ষ্য করা তাও নয়। এটা আসলে প্রত্যেকের নিজেকে বিব্রত না করা। তাঁকে স্বীকার করা এখানে নেই কোথাও। অস্বীকৃত হতে থাকার যন্ত্রণা তাঁর কাছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকার ফলে সে আর এই যন্ত্রণাকে অস্বিকার করার খেলা খেলে না। বরং সে এখন এই যন্ত্রণা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে দক্ষতাই পেতে চায়। বেশ কিছুটা দক্ষতা যে তাঁর ইতিমধ্যেই এসেছে , এটা সে নিজেও টের পায়। ট্রেনে উঠে সে দাঁড়ালো। তাঁর নিজের মত একটা কোণ আছে। এই সময়টা মনে হয় যেন একটা অনন্ত অপেক্ষা অতিক্রম করতে হবে তাঁকে। এভাবেই। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাঁর সহযাত্রীদের দিকে তাকাল। অন্যদিনের মতোই। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। শুনছে। অথবা শুনছে না। চুপ করে আছে। অথবা অন্য কোন ব্যাস্ততায় উদাসীন হয়ে আছে। ওরা কেউ তাঁকে দেখছে না। এটাই তো স্বাভাবিক। ওরা কেউ তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরছে না। যেন তাঁর সঙ্গে বিনিময়ের কিছু নেই তাঁদের। সে একটু অন্যরকমভাবে অবাক হল এখন। এরা এত সামর্থহীন ... এত অসংবেদনশীল ... না কি এটা তাঁদের কৃপণতা শুধু , যে তাঁর সাথে বিনিময়ের কোন ঘটনাই কোন গুরুত্বই রাখে না তাঁদের কাছে। কিন্তু তাঁর কাছে কি দেওয়ার মত কিছু নেই ? আছে তো। তাঁর যে শ্বাসে-প্রশ্বাসে , হৃৎস্পন্দের ধ্বনিতে মহাকাশের কিছু সুদূরতর সুর বেজে ওঠে মাঝেমাঝেই। কিছু তূরীয় বিষাদ। কিন্তু তাঁর জন্যে তো লক্ষ্য করতে হবে। কাছে আসতে হবে অথবা ডাকতে হবে তাকে।সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হাতঘড়িটা দেখল। আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে এই যাত্রা শেষের ? ... নশ্বরতাকে এইভাবে মেপেমেপে চলা বেশ ছন্দময় লাগে তাঁর। ঘড়ি থেকে চোখ তুলে যেই সে সামনে বসে থাকা মানুষের সারির দিকে তাকাল, বেশ অবাক হল, প্রকৃত অর্থে অনেকদিন পরেই। ওই বসে থাকা মানুষের ভিড়ের মাঝখানে , তাঁর বিপরীতে , দুটি চোখ শুধু। তাতে টলটল করেছে জল। অশ্রু। আর কিছু নেই। মানে মানুষটার অবয়বের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শূন্য। সে অনেক বিষণ্ণ মানুষ দেখেছে । কিন্তু এভাবে কাউকে দেখেনি। বিশেষত নিজে ফিকে হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার পর এভাবে শুধু অশ্রুময় দুটি চোখ দেখে ফেলা নিদারুণ রোমাঞ্চের মত। অনুপ্রেরণার মত। যেন সেই একই তূরীয় বিষাদ ওই মানুষটাও জেনেছে। তবে কি এই মানুষটি বিষাদ বিনিময়ের প্রাসঙ্গিকতায়, দেখতে পাবে ? লক্ষ্য করবে তাঁকে ? সে ওই দুটি অশ্রুময় চোখ লক্ষ্য করে বলে উঠল -আপনি কি আমারই মত একজন ফিকে হয়ে যাওয়া মানুষ ? অথচ দেখুন আমি আপনার দুটি চোখ দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি , আপনার চোখে জল। -আমিও দেখতে পাচ্ছি আপনাকে। দেখতে পাচ্ছি আপনার চোখেও জল। -সে কী ! আমি কাঁদছি ! কই , আমি তো টের পাইনি ? কিন্তু আপনার শরীরের বাদবাকি আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন ? -সে তো আপনারও অবশিষ্ট শরীর আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে একটু থমকালো। তবে কি যা কিছু ঘটছে তা বুঝে নেওয়া শুরু হবে এবার। সে বলে উঠল -এমন কেন ঘটছে বলতে পারেন ? -আসলে যে মহাজগতিক বিষাদ আপনি খুঁজে পেয়েছেন , সঞ্চয়ে রেখেছেন আপনার হৃদয়ে , তা পরিণত হতে শুরু করেছে। -পরিণত ? কি করে বুঝলেন ? -এই অশ্রুই তাঁর প্রমাণ। মহাজাগতিক বিষাদগুলি পরিণত হলে এমনই অশ্রু হয়। এই অশ্রুতে যতটুকু অবগাহন সম্ভব হবে , আপনি ততটুকুই ফিরে পাবেন নিজেকে । ততটুকুই দেখতে পাবেন সেই মহাজগৎ আর তাঁর বাসিন্দাদের। -তাহলে আপনি সেই মহাজগতের একজন ? -হ্যাঁ। আর আপনাকেও এই জগতে স্বাগত। -কিন্তু আমি আপনার সবটুকু দেখতে চাই। আপনার সব আলো পেতে চাই। -তাহলে আপনাকে আরও অশ্রুময় হতে হবে। সেই অশ্রুর ভিতরে পূর্ণ অভিষিক্ত হতে হবে। আপনি প্রস্তুত ? -আমি প্রস্তুত। কিন্তু সে অভিষেকের জন্যে যে আমার আরও আরও বিষাদ প্রয়োজন ... আপনি দেবেন আমাকে তত বিষাদ ? ... প্লিজ দিন না , আমি যে আপনাকে সম্পূর্ণ দেখতে চাই , দেবেন না ... সে তাকিয়ে থাকলো সেই দুটি চোখের দিকে ... সেই দুটি চোখ তাঁর দিকে ... অপলক অশ্রু ... চোখের জলের এক আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি থাকে ... তাঁদের দুজনেরই কি একসাথে মনে পড়ে যাচ্ছিলো সব ... লৌকিক বিস্মৃতিগুলি কি ব্যর্থ হয়ে আসছে এবার ...।।

Saturday 27 January 2018

বেবী সাউ

বিশেষ নিবন্ধ
হৃদয় নিঃসৃত 
কান্দনাগীতি 

এবং কিছু মুহূর্ত




গ্রাম আমাকে টানে। পরিবেশের মোহনীয় রূপের স্নিগ্ধতা, সহজ সরল একাত্মবোধ-- মানুষের প্রতি মানুষের টান, কোন্দল, পশুপাখি প্রেম, এমনকি মাটির প্রতি আন্তরিক অনুভব কোথাও পাওয়া যায় তো--- তা এইসব বাংলার গ্রামগুলিতে। অনুভবের সঙ্গে অনুষঙ্গের আত্মীয়তাবোধ, একে অপরের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া, আলাদা হয়েও একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস, গ্রামগুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অবশ্য শরৎচন্দ্রের বর্ণিত গ্রাম বা উপন্যাসের ফুটে ওঠা গ্রামগুলি এখন বিলুপ্ত প্রজাতির। তাও বাংলার প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে গ্রামবাংলার সহায় হতেই হবে।  আনাচে কানাচে বেজে ওঠা ঝুমুর সুর; সন্ধের আকাশ ভরে ওঠে কীর্তনের সুরে। বারো মাসে তেরো পার্বণ তো লেগেই আছে। বিশ্বায়নের প্রকোপ যদিও ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে গ্রামগুলিতে; তবু নাড়ীর টানে মতো নিজস্বতা এখনও বেঁচে আছে। এখনও একে অপরের দুঃখে হাসে কাঁদে। উৎসব করে। বাবা বলেন,"যেসব গ্রামগুলিতে এখনও বিদ্যুতের আলো পৌঁছাতে পারেনি, যেখানেই পাওয়া যাবে আসল গ্রাম্য পরিচয়, অরিজিনাল সংস্কৃতি।" কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে-- তা কী সম্ভব! প্রতিটি গ্রামে গড়ে ওঠছে সরকার দ্বারা নির্মিত  ক্লাবঘর,  কালার টিভিতে রগরগে গান, সিরিয়ালের রমরমা। লাখ লাখ টাকা বাজেট দেওয়া হচ্ছে মেলার। আর ওই টাকাতে কোনও এক টলিউড নায়িকা এসে নেচে গেয়ে যাচ্ছেন। আর গ্রাম বাংলার ঝুমুর গায়ক, জাওয়া,  টুসুগান, কাটিনাচ, বহুরূপীরা হাত লাগিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সড়কযোজনায়। কোথায় পর্ব-পার্বনের নিজস্ব আঙ্গিক! কোথায় বা সেই পয়ারবদ্ধ গ্রাম্য গীতির সুরের লহর।  কথা প্রসঙ্গে কথা বেড়ে যায়। যাইহোক, যেকথা বলতে চাইছিলাম।




ছোটবেলাটা কেটেছে আমার ঠাকুমার সাহচর্যে। ঠাকুমার কাছে ছিল অফুরন্ত গল্পের ঝুলি, গীতির সুর আর লোকায়ত সমাজের মোহনীয় রূপকথারা। সমস্ত সংসারের দায়-দায়িত্ব মা-জেঠিমাদের ওপর জেড়ে দিয়ে তিনি আমাদের আশ্চর্য আশ্চর্য গল্পকথা। কার্তিক মাসে ভাঁজতেন ব্রতের সুর। রাময়ণ, মহাভারতের গল্প। কিন্তু যখনই  ঠাকুমার মনখারাপ হত, কিংবা কোন দুঃসংবাদ--- আমাদের কড়ি-বরগায়,  বাড়ির আনাচে- কানাচে গুঞ্জরিত হত এক করুণ সুর। ঠাকুমা কথার মাধ্যমে, সুরের মাধ্যমে কেঁদে কেঁদে বর্ণনা করতেন তার জন্মমৃত্যুশোক, হাসিকান্না। তাঁর অভিমান, অভিযোগ। আমি তখন খুব ছোট। তখন আমার এসব গীতিগুলিকে কখনোই কান্নার উপযুক্ত স্টেপ বলে লাগেনি। মনে হয়নি এসব আসলে কান্না। ঠাকুমার অসন্তোষ, অভিযোগগুলি আমার কাছে লাগত কোন সুদূর অতীতের দ্বীপ থেকে ভেসে আসা বন্দিনী রাজকুমারীর লোকগাথা। যে রাজকুমারীকে কালো কালো শরীর, লাল টকটকে চোখের রাক্ষসেরা বন্দি করে রেখেছে। আমার বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার লাগত। ঠাকুমা কারো মৃত্যুর খবর শুনে গুণগুণ করে কাঁদতেন। তুলে আনতেন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে তার যাবতীয় অনুভব। প্রতিটি কথা স্পষ্ট বোঝা যেত; সুরটা ছিল করুণ। আমরাও, তখন ছোট, পুতুলবিদায়ের সময় এই সুরটা ভাঁজতাম। আমাদের বাড়িতে, গরুগুলির দেখাশোনা করত নরহরি নামে একজন। নরদাদা আমার ছোটবেলার সমস্ত ইচ্ছেগুলোকে সাকার রূপ দিত। গাছ থেকে শালিখের বাচ্চা পেড়ে আনা, কাঠবিড়ালির খোঁজ, ডাহুকের অতিচঞ্চল বাচ্চাদের পাকড়ায়ো সবকিছুর উপায় ছিল নরদাদা। কবিতা বৌদির সঙ্গে ওরা থাকত আমাদের বাগানের উত্তরের ঘরে। শান্তশিষ্ট মানুষ। সেই নরদাদা যখন রাতে মদ খেয়ে মাতাল হত; তখনই দুমদাম পেটাত কবিতাবৌদিকে। পেটানোর পরে তার আর কিছু কাজ থাকত না তার; ঘুমিয়ে পড়ত। তারপর আসল কাজ শুরু করত কবিতা বৌদি। সারাটা রাত গভীর করুণ স্বরে তার জীবন-অতীতের সমস্ত চিত্র তুলে আনত। মৃত ভাইয়ের কথা, মা বাবার কথা, সখীর কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যেতাম। কানের মধ্যে অস্পষ্ট ভাবে ভেসে আসত এইসব করুণ রাগ-রাগিনী। এভাবেই লোকায়ত জীবনের ধারাগুলি মিশে যেতে থাকে আমার ভেতরে--- অনুভবে।

আমার যখন ক্লাস ফোর; ঠাকুমা মারা যান। হারিয়ে যায় রূপকথা, রাক্ষসের সাতমহলা বাড়ি, আর করুণ গীতের বাহার। আমরাও খুব দ্রুত বড় হয়ে যাই। স্কুল হোস্টেল কলেজের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে যায় ছোটবেলার অনুভব। জুন মাস, দু’হাজার ষোলো। বাবা বললেন, "... এইসব কাজগুলি হারিয়ে যাচ্ছে , শুরু করতে পারিস।" ততদিনে আমাদের গ্রামে ওসব গ্রাম্যগীতির বালাই ঘুচেছে। সবাই সন্ধেবেলাটা কাটায় স্টার জলসায়। কোন কান্না আর সুরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। বালিশের কোল কিংবা অভিমানেই শেষ হয় কান্নার আয়ুকাল। আমিও তেমন, খোঁজ চলল, কোথায় কোথায় এখনও বেঁচে আছে কান্নার ঐতিহ্য। গ্রামের ঠাকুমাদের ধরলাম। কিন্তু তারাও ভুলতে বসেছে "কান্দনাগীত"। এক দুলাইন মনে আছে হয়তবা। এগিয়ে গেলাম আরও সীমান্তের দিকে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ছোট গ্রাম আসনবনী। একটু এগোলেই ঝাড়খণ্ডের সীমানা; ওড়িষ্যার বর্ডার। জনসমাজে মিশ্র সংস্কৃতি। ওড়িষ্যার মেয়ে এসে সামলাচ্ছে এবাড়ির বাংলা সংসার। ঝাড়খণ্ডের মেয়েটি দেখছে বাংলা সিরিয়াল। আবার বাংলার মেয়েটি গিয়ে নতুন ভাবে শিখচ্ছে ওড়িয়া অক্ষর। এক মিশ্রবোধ। মিশ্র কালচার।




  বাংলা ওড়িয়া হিন্দি তিনটি ভাষার সংস্পর্শে তৈরী হয়েছে সুর্বণরৈখিক ভাষা বলাবাহুল্যএই অঞ্চলের মুখ্য নদী সুর্বণরেখা আর সুর্বণরেখার দুকূল জুড়ে গড়ে ওঠা জনসমাজের ভাষাটা এক নতুন টাইপের স্বাভাবিকভাবে এইসব এলাকার মানুষজন হিন্দিবাংলা কিংবা ওড়িয়া ভাষাতে পড়াশোনা করলেও সমাজেবাড়িতে এই সুর্বণরৈখিক ভাষাতেই কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সুর্বণরৈখিক ভাষা কাজ করতে গিয়েএকটা মজার ঘটনা বলি যেহেতু আমি বাংলাহিন্দি কিংবা ওড়িয়া ভাষাটা ভালোরকম জানি তাই আমার এই সুর্বণরৈখিক ভাষাটা বুঝতে এতটা প্রব্লেম হয়নি কিন্তু একদিনঘুরে ঘুরে এসব কাঁদনাগীতি গুলি সংগ্রহ করছিতখন একজন ছুটে এসে আমাকে বললেন-- "মদনার মা আসিছে ঠিয়া হিছেসে অনেকগা কাঁন্দনাগীতি জানেএএঠকে আসতে নাজায়ডে" বাকি কথাটা বুঝতে পারলেও আমি কিছুতেই 'ঠিয়াশব্দটি বুঝতে পারিনি 'ঠিয়ামানে কোন অসুখের কথা ভেবেছি ভাবলামঅসুখের জন্য আসতে লজ্জা পাচ্ছে আমি তখন অন্য একজনের গান রেকর্ড করছি ছেড়ে যেতেও পারছিনা কিন্তু যাওয়াটা জরুরী ভেবে সব বন্ধ করে ওই লোকটির সঙ্গে গেলাম দেখি একটা মহুলগাছের নীচে মদনার মা দাঁড়িয়ে আছেন কালো চিক্কন স্বাস্থ্যবতী মহিলা বয়েস পঞ্চাশ মতো জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ কোন অসুখের লক্ষণ নেই আর আমি প্রথমে আলাপ জমাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বসেছি অসুখের কথা সবাই তখন আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা সবাই জানে মদনার মায়ের কোন রোগ অসুখ নেই স্বাস্থ্যবতী মহিলা উফ!  ভাবুন আমার অবস্থাটা তখন যতই আমি ওদের কাছে বড়াই করিনা কেনতোমাদের ভাষাতেই কথা বলবোওরা হেসে কুটিপাটি খায় আবার সাহায্য করে




কাঁদনাগীত সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি; সঠিক পরিবেশ না এলে কখনও সুর ঠিকভাবে প্রকাশ পায় না। আমি যদি হঠাৎ সকালবেলা গিয়ে বলি,--- "মাউসি, গটায় কাঁদনাগীত শুনাও; শুনমু!" কোনমতেই তা সম্ভব নয়। হয়তবা, আমাকে স্নেহবশত, মহিলাটি গানটি গেয়ে দেবেন কিন্তু কোনমতেই গানটির অরিজিনাল সুর কিংবা ভাব কিছুই আসবে না। এমনকি কথাগুলোও পাল্টে যাবে। তাই ফিল্ড ওর্য়াক করতে গিয়ে বুঝেছি সঠিক পরিবেশের অভাবে যথাযথভাবে কোন গান আসছে না। এইজন্য দীর্ঘ অপেক্ষার প্রয়োজন। গানগুলি শোনার মোক্ষম সময় হচ্ছে বিবাহউৎসবের পরে কন্যা বিদায়কালে। কন্যা বিদায় নিচ্ছে আর বাড়ির অন্দরমহল থেকে দালান পর্যন্ত কেঁপে যাচ্ছে করুণ চোখের জলে। কন্যাটি প্রত্যেকের কাছে বিদায় চাইছে; করুণ গীতের মাধ্যমে। এই বিদায় পর্বের নিজস্ব কিছু text আছে। দাদার কাছে কান্নার জন্য, মায়ের কাছে, বাবার কাছে, বৌদি, কাকিমা,  সখী--- ভিন্ন ভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রূপ, আলাদা আলাদা পাঠ বা text । যেমন একটি গান---

"উঠিলা সুয়ারি বসিলা নাই, মাগো
নদী পারাইবাকে দিশিলা নাই মাগো
কত যে আদর করিথিল তুমি মাগো
ভাগ্যে মোর কী আছে না জানি মাগো..."

আবার মৃত্যুর সময় গানগুলি পাল্টে যায়। তখন আরো হাহাকার ঢুকে পড়ে গান গুলির আনাচে কানাচে। আরও বিলম্বিত হয়ে ওঠে সুর। মৃত ব্যক্তির প্রতিটি স্মৃতি জ্বলজ্বল করে ওঠে গানের মাধ্যমে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা তাদের স্মৃতির আনাচে কানাচে থেকে তুলে আনা এইসব গানের কথা। সে অর্থে বলতে গেলে কান্দনাগীতি গুলির কথাগুলি সদ্যউত্থিত। কোন বাঁধাধরা  কবিতার লাইন নয়, শাশ্বত চিরন্তন পংক্তি নয়--- তাৎক্ষণিক। মুখে মুখে রচিত চলন্ত ইতিহাস। এরকম একটি মৃতের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম আমি। বিশ্বাস করুন, এমন করুণ দৃশ্য আমরা যারা শহরে থাকি অনুভবের মধ্যে আনতে পারিনা। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হৃদয় বিদারক দৃশ্য। তার সঙ্গে জড়িত গানের করুণ রাগিণী। মেয়েরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অতীত  থেকে তুলে আনা মৃতব্যক্তির সুখ স্মৃতিগুলি গেয়ে চলেছেন। সদ্যপতিহারা মেয়েটি চোখের জলে লিখে চলেছে তার দুর্বিষহ ভবিষ্যৎ। পুত্রহারা মা-টি ছেলের স্মৃতিতে জর্জরিত। গানের মাধ্যমে বিলম্বিত সুরে এসব শোকগান গাওয়া হয়। গাছগাছালি পর্যন্ত কেঁপে ওঠছে এসব করুণ সুরে।  স্বাভাবিকভাবে আমি এসব গান রেকর্ড করতে পারিনি। পারিনি মানুষের হৃদয়টুকুকে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের হাতে তুলে দিতে। বিবেকে বেঁধেছে; টেপ রেকর্ডার কিংবা মোবাইল ফোনের রেকর্ড সুইচটাই খুঁজে পাইনি কোনমতে। ব্যক্তিটি অপরিচিত হলেও, তার সম্পর্কে আগে কিছু না জেনেও-- আমার চোখের জল বাঁধ মানেনি। গানগুলি শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম ব্যক্তিটির যাবতীয় পরিচয়। সন্তানের প্রতি তার স্নেহ কেমন ছিল, কেমন ছিল তার দাম্পত্য কিংবা তার দুঃখ কষ্টময় জীবনযাত্রা। ডাক্তার দেখাতে না পারার খেদ, অভাব- দারিদ্র একটা মানুষকে কেমন কালরোগে টেনে নিয়ে গেছে তার বাখান। গানের কথাগুলি শুনতে শুনতে নিজে আমিও হয়ে উঠেছিলাম তাদের একজন। একবিংশ শতাব্দীও  লজ্জায় চুপ ছিল সেদিন।

" একি থিলা মোর কপালে গো
একি থিলা মোর কপালে
মোকে ছাড়ি তুমহি চালি গেল কঁঠে
তুমহি বলিথিল মোকে নিই যাব..."

এইসব শোকগানগুলিও "কান্দনাগীতি" নামে পরিচিত। রাজস্থানের 'রুদালি' জাতি যেভাবে শোকপ্রকাশ করে তা থেকে এ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কান্দনাগীতিগুলি লোকায়ত জীবনের নিজস্ব রচিত। তাৎক্ষণিক ভাবে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনেরা নিজস্ব সুরে, কথায় এসব গান গেয়ে চলেন ঘন্টার পর ঘন্টা। অবশেষে কিছুটা শোক প্রশমিত হলে তারা মৃতদেহের সৎকারের অন্যান্য উপাচার জোগাড় করেন। আবার দেখা যায়,  মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে উঠে আসছে আরও অনেক মৃত পূর্ব পুরুষদের কথা । এ পর্যন্ত  সমস্ত ঘটে যাওয়ার শোক যেন একত্রিত হয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে।

এইসব মানুষদের কাছে পেয়েছি অন্তরের বোধ; অসীম আত্মীয়তা। অতিথিদের এরা দেবতা ভাবেন। আমাকে এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে দেননি যে আমি বাইরের কেউ। পাথরডাঙা( ঝাড়খণ্ড- ওড়িষ্যা সীমান্তের একটি গ্রাম) গ্রামে যখন যাই, এখানকার ভাষাতে ওড়িয়া টানটা বেশি। ভাষাতেও ওড়িয়া শব্দের আধিক্য। পাথরডাঙা ঝাড়খণ্ডের একটি গ্রাম। সুর্বণরেখা নদীর পাড় ঘেঁষে। নদীর এপাশে ঝাড়খণ্ড, অন্যপাশে ওড়িষ্যা। তাই ভাষাতে হিন্দি শব্দের চেয়ে ওড়িয়া শব্দ বেশি। এখানেও একটা মজার কথা বলি। আমি গেছি। ওরা সবাই আমার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে কিছু খাওয়ানোর জন্য সবাই ব্যস্ত। আর আমি সলজ্জে সবকিছু বারণ করছি; খাওয়া সম্পর্কে অনীহা তার কারন। তারমধ্যে একজন, মধ্যবয়েসী মহিলা এসে বললেন---" টিকে ক্ষীর আনুছি। খাইতে হব।" আমিও ভাবলাম  ক্ষীর ( রাবড়ি) টা না ছাড়াই ভালো। খেয়ে নিই। আমি 'হ্যাঁ' বলতে উনি ছুটে চলে গেলেন। ওমা! কিছুক্ষণ পরে দেখি ইয়া বড় একটা কাচের গ্লাস ভর্তি ধোঁয়া ওঠা গরম দুধ। এইটা 'টিকে ক্ষীর'! তারপর অনেক বলার পরে আমি অর্ধেকটা দুধ কম করাতে পেয়েছিলাম। বাকি অর্ধেক আমাকে ওই দুপুরবেলাতেই উদরসাৎ করতে হয়েছিল। তো এখানকার গানগুলিতে ওড়িয়া ভাষার টান বেশি। বেশীরভাগ  শব্দের শেষে 'অ' স্বরবর্ণের টান। সুমিষ্ট একটি ভাষা। হিন্দি, বাংলা শব্দগুলিও ওইভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। কাঁদনাগীতি গুলিতে দুঃখময় জীবনের কথা, পণপ্রথা, গার্হস্থ্য জীবনের প্রতিচ্ছবি যেমন প্রস্ফুটিত তেমনি নারী নির্যাতনের চিত্রটাও বেশ সুপোক্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। এরকমই একটি গান---

" মোর শুশুরা যে নিমনমুহা বউগো
ঘরকু আসিলে জ্বালিবে নিআ বউগো
কানকুল কান্টা জ্বালিতে দিবে বউগো
বালটিএ পানি ঢালি দিবে বউগো"

জ্ঞাতার্থে ---এই গানটি এক শ্বশুর বাড়িতে নির্যাতিতা মেয়ে তার নির্যাতনের কাহিনী মায়ের(বউগো) কাছে বর্ণনা করছে। এইসব লোকায়তজীবনে যা অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িত। গানগুলিতে সমাজ চিত্রটা দারুণ ভাবে উঠে এসেছে। নারীজীবনের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সুস্পষ্ট।

এইগানগুলি দণ্ডছত্র মাঝি, কুমার, কুমোর, সদগোপ, তিলি, কুরমালি এইসব জাতির মধ্যে অধিক প্রচলিত। সাঁওতাল, হো, মুন্ডা জাতির মধ্যে এসব গীতির প্রচলন নেই। মালভূমি অঞ্চলের রুক্ষ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কঠোর জীবন সংগ্রামের, গানগুলিতে সেই চিত্রকল্প উপস্থিত। মালভূমি এলাকা বলেই এসব অঞ্চলে দুঃখদারিদ্রও বেশী। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম। এই সংগ্রামময় জীবনে তাদের নিত্যদিনের কান্না; চোখের জল ফেলা। গীতিগুলিতেও এইসব দুঃখদারিদ্রময় জীবনের কথা, কষ্টের কথা, বিচ্ছেদের কথা উঠে এসেছে প্রতিনিয়ত। জীবনসংগ্রামের জ্বলন্ত দলিল এই গানগুলি। গানগুলিতে কোন নীতিকথা নেই, কোন মুক্তির উপায় বলে দেওয়া হয়নি--- শুধু হাহাকার, কষ্ট আর জীবনসংগ্রামের ইতিবৃত্ত যেন।

একদিন একজনের বাড়ীতে পৌঁছে দেখি, পুরো হুলস্থুল কান্ড। সবাই খুব আনন্দে। উঠোন নিকোনো। চারপাশে শামিয়ানা টাঙানো। আমি পৌঁছোতেই সবাই খুব খুশি। বসতে দিল। একটা খাটিয়াতে আমি বসেছি। দেখি কেউ আমার ওড়নি ধরে টানছে। কে রে বাবা! চমকে দেখি একটা ছাগল উঠে এসেছে ওই খাটে! ওদের দৈনন্দিনজীবনের সঙ্গে পশুপাখিরাও মিশে গেছে। তো যেটা বলছিলাম! এই উৎসবের কারণটা জানতে চাইলাম। বাড়ির যিনি কর্তা, জানালেন, তার মেজোছেলে আবার বিয়ে করে বৌ এনেছে ঘরে! আমি তো চমকে উঠলাম। বলে কী! মেজো ছেলে তো বাইরে কিছু একটা কাজ করে। দুদিন আগে প্রথম বৌকে নিয়ে বাড়ী এসেছে! আবার বিয়ে? জিজ্ঞেস করতে জানালেন, আসলে তাঁর মেজো পুত্রবধূর দীর্ঘদিন ধরে কোন সন্তান হচ্ছে না। তাই মেজোছেলের আবার বিয়ে দিয়েছেন সবাই মিলে। তাই এই উৎসব। প্রথম বৌটি কোথায় জিজ্ঞেস করতে বাড়ির পিছন দিকটা দেখিয়ে দিলেন। আমি গিয়ে দেখি, একটা ছোট্ট ডোবার কাছে বসে গুণগুণ সুরে প্রথমবৌটি কাঁদছে। সে তার বিয়ের দিনের স্মৃতি,  পুরোনোদিনের কথা; স্বামী সোহাগের কথা, মা-বাবা ভাই বোনদের কথা মনে করে করে বলছে তার তাতেই সুর বসিয়ে কাঁদছে। নারীজাতির প্রতি এই অবিচার দেখে আমিও নিজেকে সামলাতে পারিনি। ওর স্বামীকে খুব বকেছিলাম সেদিন। পুলিশে জানিয়ে দেব বলেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি কিছুই করতে পারিনি। কিছুই না। আমার শিক্ষিত মুখোশ শুধু ওই ক্রন্দনরত মেয়েটিকে মিথ্যে কিছু আশ্বাস দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এসব গানও আমি কিছু রেকর্ড করতে পারিনি। শুধু স্মৃতিতে যে ক'টি গান ছিল তাই লিখে রেখেছিলাম পরে।

" পেঁপুড়ি চালি থায় ধাড়িকে ধাড়ি কাকীগো
মুই চালি থাউন ঘড়িকে ঘড়ি কাকীগো
ঘড়ি ঘড়ি আসা অসুখ পাওয়া কাকীগো
এবা তো তুমার নিশ্চয়ে রহঅ কাকীগো"

এরকম বহু ঘটনার সঙ্গে দিনের পর দিন কাটিয়েছি। অনুভব করেছি তাদের দুর্দশাময় জীবনের কাহিনি।  অভিযানের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছি নিজেকে। কখনো সখনো  ওদের ভাবনার সঙ্গে মেলাতে পারিনি আমার ভাবনাকে। তাও একদিনের জন্যেও নিজেকে বাইরের কেউ লাগেনি। ওরা বুঝতেই দেয়নি, সুদূর জামশেদপুর থেকে আমি জাস্ট দু’দিনের অতিথি হয়ে গেছি বলে। বরং ভালোবাসা দিয়ে, একাত্মতা নিয়ে আপন করে নিয়েছে আমাকে। ভালোবেসে ভাষা শিখেয়েছে। উচ্চারণ শিখিয়েছে। গানগুলির সুর শিখিয়েছে। ভুল হলে খিলখিল করে হেসে উঠেছে। আমাকে সন্ধান দিয়েছে কে কে এই গানগুলি জানে? কোথায় গেলে আরও বেশি করে গানগুলি পাবো? আমার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য সেকি আহ্লাদ ওদের। সেকি অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস! সঙ্গে সঙ্গে আফশোষ করেছে ওই ক'জন বৃদ্ধার মৃত্যু হলে এসব গানগুলিও হারিয়ে যাবে, কেননা, নতুন প্রজন্ম এসব গান গাইতে চায়না। ঐতিহ্য মানতে চায় না। হঠাত্‍ই ক'দিন আগে জানতে পারলাম পারুলরানী মারা গেছেন। বর্ষাকালে পা ভেঙে কতদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তারপর একদিন মারা যান। কষ্ট লেগেছিল। কিছু করতে পারিনি ওদের জন্য তাই কষ্ট। কিছু দিতে পারিনি বলে তাই কষ্ট। কিন্তু...আমি কীই বা করতে পারতাম! হয়ত সেভাবে চাইলে পারতামও। 

'কান্দনাগীত' সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি এসব গীতিগুলি শুধুমাত্র নারীজাতিরাই গায়। পুরুষেরা এসব গাইতে পারেনা, এসব গান বাধতে পারে না। উবু হয়ে বসে কোনও নির্জন জায়গায় আপনমনে এইসব গানগুলি গায় শুধুমাত্র নারীরাই। নারীদের অধিকার, বিচারবোধ, ভাবনা, অনুভব এসব গানগুলির মুখ্য বিষয়বস্তু। নারীসমাজের জীবন্ত দলিলস্বরূপ। ঐতিহ্যমন্ডিত। নারীর যন্ত্রনা, ক্ষোভ, শোক, দুঃখ, বিষাদ, বঞ্চনা--- গানগুলিতে পরিস্ফুট। তাই গানগুলি খুবই আবেগময়। হৃদয় উৎসারিত। শুধু দুঃখময়, লাঞ্ছিতময় জীবনের উপকথা গানগুলির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। কিন্তু গানগুলিতেও কোন ধর্মের কথা, রাজনৈতিক চিত্র পাওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের ওড়িশা সীমান্তবর্তী পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন বর্ণের সমাজে(caste) এই গানগুলির চল। তাছাড়া ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, বালেশ্বর অঞ্চল ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলায় এই গানের প্রচলন আছে।

ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে গিয়ে বুঝেছি, "কাঁদনাগীতি" একটা স্বতন্ত্র আবেদন। সম্পূর্ণভাবে জীবনাশ্রয়ী এই গানগুলিতে নারী সমাজের নির্যাতিত করুণ অবস্থানটি ফুটে উঠেছে। কাঁদনাগীতিগুলির গহন-গহ্বরে ঢুঁ দিলে দেখা যাবে নারীদের প্রেম, যন্ত্রনা, হাহাকার, বিরহ, অভিযোগ, মান-অভিমান, আর্ত-বিরহ, বেদনাভর্তি হৃদয়ের কথা বড় হয়ে উঠেছে। গানগুলির নিজস্ব কিছু টেক্সট্ আছে। গানগুলি দুঃখের অস্থিস্বরূপ। কিন্তু নগরায়ন, বিশ্বায়নের ফলে গানগুলি আজ বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্ম প্রজন্মের নারীরা পরিবর্তনের ধারায় কিছুটা সংস্কৃতির কিছুটা গ্রহণ করলেও এই গানগুলি আজ বিলুপ্তির পথে।

জীবনভাবনা অর্থাৎ জীবনচেতনার মর্মমূলে এই গানগুলির সৃষ্টি হয়েছে। গানগুলির মূল্য অপরিসীম। এই গানগুলি নিয়ে নতুন প্রজন্ম, লোক-সংস্কৃতির গবেষকদের এগিয়ে আসা উচিত--- এসব ভাবতে ভাবতে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। সূর্যাস্ত আলোয় বাজছিল ইমন সুর। কল্যানময়ী গ্রামের  লাল ধুলোয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছিল দুঃখের ভগ্নাংশগুলি।

" মা'র  কাছে বলবি দাদা ভালো সুখে আছি
ঝিঙা ফুল ফুটলে দাদা দাতুন করতে বসি
কাঁকুড়ফুল ফুটলে দাদা ভাত খাইতে বসি
মা'র কাছে বলবি দাদা ভালো সুখে আছি..."

ছবি ঃ লেখক

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...