Sunday 28 January 2018

শ্যামল ভট্টাচার্য




অপলক দৃশ্য 


সকাল বেলায় চোখ খুলে যে আলো সে দেখতে পেল তাতে বুঝতে পারলো , যে আশ্চর্য ব্যাপারটা চলছিল এতদিন , তা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। সম্ভবত তাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো , তাঁর এই ফিকে হয়ে যাওয়াটা ... শেষ কয়েকমাস বিষয়টা যেন একটা সাংঘাতিক গতি পেয়েছিলো। যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় মানুষেরা তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখছিলো না , যেভাবে সেমত উপেক্ষা মানতে না পেরে সে আগ্রাসী হওয়ার চেষ্টা করেছে যখনই, সবাই চমকে উঠছিল , তখনই সে নিজের ফিকে হয়ে যাওয়ার গতি সম্পর্কে সন্দেহাতীত সচেতন হয়ে উঠতে পারছিলো। আর আজকের চারপাশের আলো প্রত্যাশিতরকমেরই আলাদা। অর্থাৎ সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কারো কাছ থেকে কোন প্রত্যক্ষ মনোযোগ তাঁর যেন আর আশা করার নেই। সে বিস্মিত হল না, রেগে গেল না , কোনরকম আবেগই চিৎকার হয়ে উঠল না তাঁর মুখে। আসলে এর জন্যে তাঁর একটা প্রস্তুতি ছিলোই। সে উঠে পড়লো। স্নানঘরে গেল। যথাযথ স্নান ঠিক হল না যেন। ফিরে এসে পোশাক পরল। আয়নার সামনে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টাও করলো না। কারণ সে নিজেকেও দেখতে পাবে না এটা সে জানে। যেমন জানে, তাঁর কোন কিছুই আর ঠিক যথাযথ হয় না তাঁর। সে খেয়ে নিল সামান্য কিছু। তাঁর খিদেও পেয়েছিলো খুব। যাদের কারণ ছাড়াই খুব খিদে পায় তাঁরা কি আসলে আবেগের দিক থেকে ক্ষুদার্ত হয়ে থাকে ... কোথাও কোন আবেগের সাড়া পায় না বলে এত খাদ্যপ্রিয়তা ... যেন ওই খাবারগুলিই প্রকৃত গ্রহন করছে প্রাণের সবটুকু আনন্দ নিয়ে তাঁকে। তাঁর আর খেতে ইচ্ছে করলো না। সে ঠিক এভাবে বাঁচতে চায় না। সে এবার তাঁর কর্মস্থলের জন্যে বের হয়ে গেল। সবকিছুই খুব মসৃণভাবে হয়ে চলেছে। ব্যাপারটা সে জানে, একেবারেই অবাক হওয়ার মত নয়। সবকিছু এভাবেই হয়ে থাকে বলে , হয়ে চলেছে। সবকিছুই রীতিনীতি প্রথা আর অভ্যাসের ব্যাপার। সব মানুষের অভ্যেসগত জীবন যাপনের যে ছক তা যেহেতু একে অপরকে জড়িয়ে থাকে , ভাবনাশূন্যভাবেই, সে-ও তাঁর ভিতরে আছে। তাঁকে নিয়ে অভ্যেসগত যে জীবনযাপন ... সেটা তো চলছে। নিজেদের অভ্যেস বিঘ্নিত হোক , এটা কেউই চায় না। এটা যে তাঁকে লক্ষ্য করা তাও নয়। এটা আসলে প্রত্যেকের নিজেকে বিব্রত না করা। তাঁকে স্বীকার করা এখানে নেই কোথাও। অস্বীকৃত হতে থাকার যন্ত্রণা তাঁর কাছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকার ফলে সে আর এই যন্ত্রণাকে অস্বিকার করার খেলা খেলে না। বরং সে এখন এই যন্ত্রণা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে দক্ষতাই পেতে চায়। বেশ কিছুটা দক্ষতা যে তাঁর ইতিমধ্যেই এসেছে , এটা সে নিজেও টের পায়। ট্রেনে উঠে সে দাঁড়ালো। তাঁর নিজের মত একটা কোণ আছে। এই সময়টা মনে হয় যেন একটা অনন্ত অপেক্ষা অতিক্রম করতে হবে তাঁকে। এভাবেই। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাঁর সহযাত্রীদের দিকে তাকাল। অন্যদিনের মতোই। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। শুনছে। অথবা শুনছে না। চুপ করে আছে। অথবা অন্য কোন ব্যাস্ততায় উদাসীন হয়ে আছে। ওরা কেউ তাঁকে দেখছে না। এটাই তো স্বাভাবিক। ওরা কেউ তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরছে না। যেন তাঁর সঙ্গে বিনিময়ের কিছু নেই তাঁদের। সে একটু অন্যরকমভাবে অবাক হল এখন। এরা এত সামর্থহীন ... এত অসংবেদনশীল ... না কি এটা তাঁদের কৃপণতা শুধু , যে তাঁর সাথে বিনিময়ের কোন ঘটনাই কোন গুরুত্বই রাখে না তাঁদের কাছে। কিন্তু তাঁর কাছে কি দেওয়ার মত কিছু নেই ? আছে তো। তাঁর যে শ্বাসে-প্রশ্বাসে , হৃৎস্পন্দের ধ্বনিতে মহাকাশের কিছু সুদূরতর সুর বেজে ওঠে মাঝেমাঝেই। কিছু তূরীয় বিষাদ। কিন্তু তাঁর জন্যে তো লক্ষ্য করতে হবে। কাছে আসতে হবে অথবা ডাকতে হবে তাকে।সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হাতঘড়িটা দেখল। আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে এই যাত্রা শেষের ? ... নশ্বরতাকে এইভাবে মেপেমেপে চলা বেশ ছন্দময় লাগে তাঁর। ঘড়ি থেকে চোখ তুলে যেই সে সামনে বসে থাকা মানুষের সারির দিকে তাকাল, বেশ অবাক হল, প্রকৃত অর্থে অনেকদিন পরেই। ওই বসে থাকা মানুষের ভিড়ের মাঝখানে , তাঁর বিপরীতে , দুটি চোখ শুধু। তাতে টলটল করেছে জল। অশ্রু। আর কিছু নেই। মানে মানুষটার অবয়বের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শূন্য। সে অনেক বিষণ্ণ মানুষ দেখেছে । কিন্তু এভাবে কাউকে দেখেনি। বিশেষত নিজে ফিকে হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার পর এভাবে শুধু অশ্রুময় দুটি চোখ দেখে ফেলা নিদারুণ রোমাঞ্চের মত। অনুপ্রেরণার মত। যেন সেই একই তূরীয় বিষাদ ওই মানুষটাও জেনেছে। তবে কি এই মানুষটি বিষাদ বিনিময়ের প্রাসঙ্গিকতায়, দেখতে পাবে ? লক্ষ্য করবে তাঁকে ? সে ওই দুটি অশ্রুময় চোখ লক্ষ্য করে বলে উঠল -আপনি কি আমারই মত একজন ফিকে হয়ে যাওয়া মানুষ ? অথচ দেখুন আমি আপনার দুটি চোখ দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি , আপনার চোখে জল। -আমিও দেখতে পাচ্ছি আপনাকে। দেখতে পাচ্ছি আপনার চোখেও জল। -সে কী ! আমি কাঁদছি ! কই , আমি তো টের পাইনি ? কিন্তু আপনার শরীরের বাদবাকি আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন ? -সে তো আপনারও অবশিষ্ট শরীর আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে একটু থমকালো। তবে কি যা কিছু ঘটছে তা বুঝে নেওয়া শুরু হবে এবার। সে বলে উঠল -এমন কেন ঘটছে বলতে পারেন ? -আসলে যে মহাজগতিক বিষাদ আপনি খুঁজে পেয়েছেন , সঞ্চয়ে রেখেছেন আপনার হৃদয়ে , তা পরিণত হতে শুরু করেছে। -পরিণত ? কি করে বুঝলেন ? -এই অশ্রুই তাঁর প্রমাণ। মহাজাগতিক বিষাদগুলি পরিণত হলে এমনই অশ্রু হয়। এই অশ্রুতে যতটুকু অবগাহন সম্ভব হবে , আপনি ততটুকুই ফিরে পাবেন নিজেকে । ততটুকুই দেখতে পাবেন সেই মহাজগৎ আর তাঁর বাসিন্দাদের। -তাহলে আপনি সেই মহাজগতের একজন ? -হ্যাঁ। আর আপনাকেও এই জগতে স্বাগত। -কিন্তু আমি আপনার সবটুকু দেখতে চাই। আপনার সব আলো পেতে চাই। -তাহলে আপনাকে আরও অশ্রুময় হতে হবে। সেই অশ্রুর ভিতরে পূর্ণ অভিষিক্ত হতে হবে। আপনি প্রস্তুত ? -আমি প্রস্তুত। কিন্তু সে অভিষেকের জন্যে যে আমার আরও আরও বিষাদ প্রয়োজন ... আপনি দেবেন আমাকে তত বিষাদ ? ... প্লিজ দিন না , আমি যে আপনাকে সম্পূর্ণ দেখতে চাই , দেবেন না ... সে তাকিয়ে থাকলো সেই দুটি চোখের দিকে ... সেই দুটি চোখ তাঁর দিকে ... অপলক অশ্রু ... চোখের জলের এক আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি থাকে ... তাঁদের দুজনেরই কি একসাথে মনে পড়ে যাচ্ছিলো সব ... লৌকিক বিস্মৃতিগুলি কি ব্যর্থ হয়ে আসছে এবার ...।।

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...