Friday 26 January 2018

সর্বজিৎ সরকার


ধারাবাহিক গদ্য















ধূসর আলোর ছায়াপথে

কুয়াশা আর শীত মনকে বড় বেশি শরীরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। ফাঁকা রাস্তা। সাদার্ন এভিন্যু ছেড়ে কেয়াতলা, পূর্ণ দাস রোড হয়ে, রাজা বসন্ত রায় রোড, লেক টেরেস, যতীন দাস রোডের,  নির্জন হলুদ কমলা আলোর ম্লান আবছায়া পথে আলো কম দেখি। কুয়াশা দেখি বেশি। শীত করে। উত্তরের হাওয়া চলছে। গলাবন্ধ সোয়েটার, জিনস, পা ঢাকা জুতো ভেদ করে সে হাওয়া, দুশো ছটা অস্থিতে কেমন শিরশিরে কথা বলতে চায়। পাতলা ধূসর আলোর সর পরে আছে বাড়িগুলোর গায়ে, ফুটপাথে, বন্ধ জানলা দরজাগুলোর ওপর। কোথাও কেউ নেই। একথাটা খুব বেশি করে মনে হয় এসময়। কথাটা সত্যি নয়, জানি আমি। আছে তারা। অনেকেই আছে। তবু এই কথাটাই ঘুরে ঘুরে কাছে আসে বেশি। তারা নয়।
ভার্জিনিয়া উলফ এর একটা কথা মনে পড়ে যায়। আমরা সকলেই কারও প্রতিচ্ছায়া। অথবা হয়ত নির্দিষ্ট কারও নয়। হয়ত অনেকের। অনেক কিছুর। বিগত কালের, আজকের, আগামী দিনেরও হয়ত। আর এই সকল ছায়াকেই তো আমরা ভালবাসি। অনুসরণ করে চলি সারা জীবন। আর এভাবে চলতে চলতে এই ছায়ারাই একসময়ে আমাদের ডেস্টিনি হয়ে যায়। ডেস্টিনি, নিয়তি নয়। যেন ডেস্টিনি নামের একটা স্টেশন যেখানে আমাদের ডেস্টিনেশন অপেক্ষায় আছে। আমাদের গন্তব্য। অজানা, অপরিচিত, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য।
শীত করে। প্যান্টের দু পকেটে হাত রেখে রাস্তায় হাঁটি। মাথাটা অল্প ঝুঁকে থাকে নীচের দিকে। জানি একটু জোরে হাঁটলে অতটা ঠান্ডা লাগবে না। তবু এই আস্তে হাঁটাটাই আমার ভালো লাগে। এই উদ্দেশ্যহীন, নিজের ভেতরে ঢুকে গিয়ে, একান্তে হাঁটাটা। বাইরে যখন হিম পড়ে, কুয়াশা ঢাকে, পাতা ঝরে, নিজের ভেতরেই তো উষ্ণতা খোঁজে মানুষ। আর কোথায়ই বা সে যেতে পারে! অনেকটা রাস্তা, অনেকটা জীবন, অনেক অনেক হেমন্তের, শীতের, কাছের দূরের অনেক মানুষের, প্রীতি, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, কামনা আর প্রত্যাখ্যান, আরো কত উপেক্ষা, অবহেলা, এসবের অনেক বেশি হাড়হিম করা স্মৃতি নিয়েই তো সে এসে পৌঁছেছে এখানে!
গ্রীষ্ম ছিলনা কোন? বসন্ত ছিল না আগে? অপেক্ষার আষাড় শ্রাবণ কিছু ছিলনা তার?
ছিল তো। সবই ছিল। কিন্তু সেসব স্মৃতির কাছে ফিরে যেতে, এই শীতে, এই হেমন্তের অনুসরণকারী শীতে, আবার তাদের কাছে ফিরে যেতে কেমন বাধোবাধো লাগে। ক্লান্ত লাগে বেশি।
লোকে গল্পে উপন্যাসে সাহিত্যে শুধু প্লট খোঁজে। একটা নির্দিষ্ট শুরু আর শেষ। কিন্তু এটাই কি সত্যি নয় যে মানুষের আর তার প্রকৃতির সব কথাই শুধু প্রান্তদেশ থেকেই উঠে আসে। এলোমেলো ছড়িয়ে যাওয়া সব কথা। ভাবনা আর কথা। আর ভাবনার আগে এক বিস্তীর্ণ অনুভবের দেশ। যেখানে সময় কখনো স্থির থাকে না। বাতাসের মত শুধু বয়ে যায়। সেখানে একটা বিশেষ খণ্ড সময়কে আলাদা করে নিয়ে তাকেই উপস্থাপিত করা লেখায়! আদ্যন্ত হাস্যকর একটা চেষ্টা। একটা অশ্লীল প্রচেষ্টা। এই প্লট।
তবু, কিছু কিছু সময়কে, ভাঙা সময়কেই হয়ত, চূর্ণ মুহূর্তকে, কাছে ডেকে নিতে ইচ্ছে করে মানুষের। সরে যাচ্ছে যে সময় প্রবাহ তার মধ্যে যে সব মুহুর্তে্রা আসছে, চলে যাচ্ছে ফের, ইচ্ছে করে তাদের পাশে দাঁড়াতে। ভাঙাচোরা জীবনকে একটা অর্থ দেওয়ার জন্যেই হয়ত। তবু সেই আংশিক সত্যকে সম্পূর্ণ সত্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা কোনও লেখকের নিজের সাথে নিজের তঞ্চকতা ছাড়া আর কী? শীতরাতের মধ্যে, কুয়াশার মধ্যে, তাই ফিরে যায় মানুষটা। আর তারই মধ্যে আর একজন কেউ, যিনি লেখেন, তিনি নজরে রাখেন মানুষটিকে। যেন ছায়া কে অনুসরণ করছে আর একটি ছায়া। নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা হয় তাদের। নিভৃত কোন সংলাপ। অদৃশ্য। অশ্রুত। কিন্তু রাস্তার মাঝে যে সব বাড়ি ঘর, গাছপালা, পাথর আর অন্য মানুষেরা আছে, কোন অজ্ঞাত উপায়ে তাদের ত্বকে হৃদয়ে সেই সব কথা দাগ রেখে যায়। সেই দাগ কোন গোপন স্বরলিপি। আগ্রহী পাঠক তাকে পড়ে নেবে কোনদিন।

মনে হয়, সকলেরই জীবনে এমন একটা সময় থাকে, যখন বসন্তকে বলতে ইচ্ছে করে, চলে এসো, কিছুই নয়, এমনিই, পাশাপাশি একসাথে কোন চেনা অচেনা রাস্তায় হাঁটবো। এমনিই এসো, সিনেমায় যাবো দুজনে। অকারণেই হাসবো আমরা। আবোল তাবোল কথা বলতে বলতে। হয়ত সেসব কথার মধ্যে বৃষ্টির জমা জলে স্নান করে কয়েকটা চড়ুই গা ঝাড়া দেবে। হয়ত কয়েকটা শালিখ ঘাসের মধ্যে লাফিয়ে বেড়াবে। হয়ত নরম রোদদুরে ঘাসে লেগে থাকা আলো  দিনের শাসন মেনে নিয়েও কিছুতেই চলে যেতে চাইবে না। হয়ত কৃষ্ণচূড়া বেশি লাল, না কি পলাশ, এই নিয়েই ঝগড়া হবে তাদের মধ্যে। হয়ত কথা বলতে গিয়ে হাত থেকে সিগারেট পড়ে গেলে বসন্ত মুখ টিপে হাসবে। মনে মনে ভাববে, ভীতুর ডিম একটা, দেখে কে বুঝবে! বলেই সে বসন্ত, তার চোখের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকবে, এতটাই ভেতর অবধি, যে মনে হবে, না কোন অতীত, না কোন আগামী, কোন কালই আর তাদের স্পর্শ করছে না। সময়ের, শুধু এই  মুহূর্তের, শুধু এই ক্ষণের, দখল নিয়ে নিয়েছে তারা। আর কেউ নেই, কিছু নেই, যা তাদের দুজনের মাঝখানে আসতে পারে।
শীত করে। কুয়াশা আর শীত তার মনকে বড়বেশি শরীরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। আর বাইরে নয়। সে তখন ভেতরের দরজাগুলো খোঁজে। শরীরের ভিতর-দরজায় এসে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজা সব। কড়া নাড়ে। যেন ওইখানে হারানো স্মৃতিরা সব আছে মাঝে মাঝে অধৈর্য লাগে তার। বসন্তের যে ঐশ্বর্য্য সে হারিয়ে ফেলেছে তাকে কী আর ফিরে পাওয়া যাবে? সে জানে, যাবে না। তবু সে আশা ছাড়তে পারেনা। ভাবে, সেই পুরনো বসন্ত না হোক, আর কোন বসন্ত কী ফিরে আসতে পারে না? হয়ত অন্য কোনও রূপে। রাস্তাগুলো পার হয়ে যেতে যেতে, লেক টেরেস, সাদার্ণ এভিন্যু পার হয়ে, ন্যাশনাল লাইব্রেরী, চিড়িয়াখানা, প্রিন্সেপ ঘাট, মিলেনিয়াম পার্কের সূর্যাস্ত পেরিয়ে যেতে যেতে, এই রকম ঠান্ডা নিঃসঙ্গ শীত পার হয়ে, এক সময়ে অন্য কোনও ছায়াসরণিতে পৌঁছে যেতে পারে তো কখনো? তার মনে পড়ে যায়, অনেক অনেক দিন আগে, এই ছায়াসরণিতেই এমন একজন থাকতেন যিনি লিখেছিলেন, এই খেদ মোর মনে, ভালবেসে মিটিলো না আশ, কুলালো না জীবনে, জীবন এত ছোট কেনে?
দুনিয়ার যে কোনও জায়গাই স্বপ্নের জন্মের কথা মনে রাখতে পারেনা। শুধু কয়েকটা রাস্তা পারে। সারা পৃথিবীতে মনে হয় এরকম রাস্তা হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র আছে। এই ছায়াসরণি তাদের মধ্যে একটা। কোন সাঁঝবেলায়, কোন কোন রাতে, এই ছায়াসরণি দিয়ে যেই হাঁটবে তার মনে হবেই যে এই রাস্তাটা, তার দু পাশের নির্জন বাড়িগুলো, তাদের খোলা চওড়া বারান্দা আর বড় বড় জানলাগুলো সকলেই সেই সব স্বপ্নদের জন্মকথা মনে রেখেছে। সে সব নিয়ে তারা কথা বলে নিজেদের মধ্যে। তখন ফিসফিস করে তাদের চাপা গলা। এটা তাদের কাছে একটা গর্বের বিষয়। তারা জানে এই রাস্তাটা নির্বাচিত হয়েছে এই কাজের জন্যে। যেন অদৃশ্য কেউ এই ভার দিয়ে গেছে তাদের ওপর, শোন আর কোনও জায়গা আপাতত পাওয়া যাচ্ছেনা। বছরটাও তোমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে স্বপ্নদের জন্মের গোপন কথাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। কথা যে বলেছে সে জানে রাস্তায় কোনও দোকান নেই। কোনও লেনদেন নেই। কোনও কেনাবেচা নেই
রাস্তাটা বেশ চওড়া। আর ছায়া ছায়া অন্ধকারে ঢাকা। আর দুপাশের বড় বড় বাড়িগুলো আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে তাদের বন্ধ দরজা বন্ধ জানলা, ছড়ানো ছাদ, খোলা বারান্দা নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। কম করে ষাট সত্তর বছর বয়স হবে বাড়িগুলোর। পুরো বাড়ি অন্ধকারে থাকে। দু একটা ঘরে শুধু আলোর সামান্য রেখা চোখে পড়ে। মানুষ থাকে এসব বাড়িতে? মনে হয় না। হয়ত দু একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। ব্যাস! আর কেউ না। শিশুরা ছিল কোনদিন। বালক বালিকারা। যুবক বা যুবতীরাও কেউ কেউ ছিল। এখন সকলেই তারা বহু দূর দেশে চলে গেছে মনে হয়। তাদের নিজের নিজের স্বপ্নকে অনুসরণ করবে বলে।
রাস্তার দুপাশের বড় বড় গাছগুলোও যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গেছে। তবু তাদের যেমন স্বভাব। ছটা ঋতুকেই এক বছরের মধ্যে পেরিয়ে যেতে চায়। সহজে মরতে চায়না।
কিন্তু মানুষগুলো তো তেমন নয়। সময় ফুরিয়ে আসছে দেখলে তাদের শীত করে। কুয়াশা আর শীত তাদের মনকে বড়বেশি শরীরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। মন আর সে ভাবে আগের মত কথা বলে না তাদের। তারা অন্ধকার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দেখে সামনের ঝাপসা অন্ধকারে, বড় গাছেদের পাতা ঝরে যাওয়া মরা ডালগুলো, কেমন প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে উঠে গেছে।
হিম পড়ছে। শীত করে। বুকের কাছে, গলার কাছে কী যেন ঠেলা মারতে থাকে। ঘরে ঢুকে আসে। আজও কী ঘুম আসবে না তবে? বিছানায় একা একা এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবে কোথায় ভুল ছিল জীবনে? তবে কি চাওয়াতেই ভুল হয়ে ছিল কিছু! ক্ষনিকের জন্যে একবার তার মনে আসে, ভালবেসে মিটিল না আশ, জীবন এত ছোট কেনে?
পরের দিন ভোর অবধি সে অপেক্ষা করবে ভাবে। অপেক্ষা? করবে?
একসময়ে ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
স্বপ্ন দেখে, পরদিন ভোরে, বসন্ত, তার তুমূল তীব্রতা নিয়ে, তার প্রবল উচ্ছাস নিয়ে, ঝাঁপিয়ে আসছে তাকে কেউ ডাকলো কি ডাকলো না সেসব জানতে বয়ে গেছে তার। আশ্চর্য ম্যাজিক জানে বসন্ত। হেমন্তের পরোয়া নেই তার। শীতের পরোয়া নেই। সে শুধু জানে, সে চায়! তীব্র ভাবে চায়। নিজেকে সম্পুর্ণ উজাড় করে চায়। সে জানে, এই প্রকাশে, এই দু হাত উন্মুক্ত করে বাড়িয়ে দেওয়াতেই তার আনন্দ, তার মুক্তি!


আবহমান এক সময় আর ছেঁড়া ছেঁড়া সব মুহূর্ত, কয়েক পলক একে অপরের চোখের দিকে তাকায়। মিলন আর বিচ্ছেদের এই বিপরীতমুখী টানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যে উন্মাদ তখন হা হা করে অট্টহাসি হাসে, লোকে তাকে বসন্ত বলে ডাকে। যেন কবিতার প্রথম লাইনটির জন্ম হল এই মুহূর্তে।
তার সেই আকূল ডাক শোনার জন্যে, আমিও, এই শীতরাতে, অনেক রাস্তা হেঁটে আসার পরেও, কিছু খয়েরি শুকনো পাতা ঝরে যাওয়ার বেলায়, খোলা দরজায় হাত রেখে সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে, শুধু এটুকু দেখবো বলে আগামীকাল সকাল অবধি অপেক্ষা করে থাকি।


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...