Saturday 27 January 2018

হিন্দোল ভট্টাচার্য


ধারাবাহিক গদ্য




মোংপো লামার ডায়েরি


তাহলে রাস্তার কথা বলছিলাম। সরাইখানার কথাও কি রাস্তার মধ্যেই পড়ে? আর সেই সব অচেনা অজানা লোকগুলির কথা, যাদের সঙ্গে দেখা হয় রাস্তায়? হয়ত অল্প কিছু কথা। কিছুক্ষণ আলাপচারিতা। ভালমন্দ, সুখদুঃখের কথা। মানুষ জীবন নিয়ে ভাবে। বেশির ভাগ মানুষ নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। ঈশ্বরের প্রতিও তাঁদের প্রবল অসন্তোষ। যে কাজটি যে সময়ে তাঁরা করছেন, তার সঙ্গে মিলে মিশে যায়, তাঁরা যা করছেন না তাও। এই ধরো, তুমি বললে, কী হবে আর লিখে। কারণ তুমি দেখছ, প্রবাহ, প্রবাহের মত চলেছে। যে যা পাওয়ার নয়, সে তা পাচ্ছে। আর যে যা পাওয়ার যোগ্য, সে তা পাচ্ছে না। আচ্ছা, তুমি ভেবে দেখেছ কী, যে যা পাওয়ার যোগ্য, সে আসলে তা-ই পাচ্ছে। তোমার হয়ত যোগ্যতা এইটুকু, যে তুমি নিভৃতে নিজের কথা বলে যেতে পারো। আর কিছু করার যোগ্যতা হয়ত তোমার নেই। যাদের রাস্তার পাশে বাড়ি হয়, তারা দেখে দূরের দিকে রাস্তা চলে গেছে। ধরো, দূর মানে দিগন্ত। আর দিগন্ত মানেই, তাকে ছাড়িয়ে আরো দূর কোথাও। কিন্তু সে হয়ত নিজে এক পাও যেতে পারে না। কিন্তু সে দূরত্বকে চেনে। অন্য অনেক পর্যটকের চেয়ে আরো নিজের করেই চেনে। কারণ কী জানো? কারণ দূরত্বের সঙ্গে তার ব্যথার সম্পর্ক। তার স্বপ্নের সম্পর্ক। তার ব্যর্থতার সম্পর্ক। সে দূরত্বকে কোনদিন পায় নি নিজের করে। আর না-পেতে পেতে, দূরত্বকে পাওয়া সফল পর্যটকদের আপাত সাফল্য দেখতে দেখতে, সে বুঝতে পেরেছে, এ পাওয়া হল সিকি-পাওয়া, এ পাওয়া হল না-পাওয়ার মতোই। কারণ সে বুঝে গেছে দূরত্বকে পাওয়া যায় না কোনদিন। তখন সে ভাবতে শুরু করে, না-হয় না-ই বা গেলাম আমি, আমি কি পেলাম না সেই অপরূপ সুযোগ? চেয়ে চেয়ে দেখে যাওয়ার? হয়ত দূরত্ব তার কাছে সেই দিবাস্বপ্ন, যা দেখতে দেখতে তার জীবন কেটে গেল। সে নিজেকে দোষ দিল বারবার, কেন এই দিবাস্বপ্ন দেখা? আর দেখব না। এ সব ভেবেও সে দিবাস্বপ্ন দেখল। দেখতে দেখতে তার বয়স ফুরিয়ে এল। লোকে জানল সে রাস্তার ধারের একটি বৃদ্ধ বট। আর কিছু নয়। সে কোথাও যায়নি কোনদিন। সে কোথাও যাবেও না। আর এই সব ভাবতে ভাবতে তার হয়ত জীবন ফুরিয়ে এল। আর যত তার জীবন ফুরিয়ে এল, তত সে বুড়ো হয়ে গেল। তার ডালে এসে বসল হরেক রঙের পাখি। তার পাতার ভিতর দিয়ে বয়ে গেল নানাগন্ধী বাতাস। তাকে স্নান করিয়ে দিল কত যুবতী বৃষ্টি। হয়ত এই সব কিছুই সে পেতে এসেছে। আসলে তো আমরা এই পৃথিবীর কাছে এসেছি পৃথিবীকে কাছে পাব বলে। বল তো, আমরা যদি পৃথিবীকেই কাছে না পাই, তাহলে আর কাকে কবে কাছে পাব?

না, আমি তাই বলে রাস্তা থেকে সরে আসার কথাও বলিনি। তুমি সরে আসার কে হে? তুমি তো নিজে আসোনি। নিজে সরে যেতেও পার না। কেউ কখনো রাস্তার কাছে আসে না। রাস্তাই তার কাছে আসে। আর রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে আসে দুপাশের ধানক্ষেত, দীঘির উপর ঝুলন্ত জলটুঙ্গি, ইটভাটা, লালচে রাস্তা, ধ্বক ধ্বক করতে থাকা পুরনো সভ্যতার মত লরির ইঞ্জিন, সোঁ সোঁ করে ছুটে যাওয়া গাড়ি, সন্ধের আলো- আঁধারিতে টিমটিমে বাল্বের মত জ্বলতে থাকা মফস্বল- এই সব। তুমি কখনো হাইরোড ধরে যেতে যেতে ক্লান্ত অবস্থায় অচেনা মফস্বলে কোনো খড়ের চালার দিশি মদের ঠেকে ঢুকে মাছ ভাজা খেয়েছ? সেই মাছ ভাজার গায়ে একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতার গন্ধ থাকে। আর থাকে হাহাকারের মত গুঞ্জন শব্দ, ঘামের গন্ধ আর অবিশ্বাসী চাহনি। নানারকম বাঁক থাকে , অলিগলি থাকে, এক নির্জন চোখের দোকানি থাকে, তার চাহনিতেই বোঝা যায়, পিকচার আভি বাকি হ্যায় দোস্ত। কিন্তু না, তুমি তো জানতে এসেছ। এই ভেবে তুমি সকলের দিকে তাকাবে। যেন মেপে নেবে সকলকে। আর তখনই তোমার কী মনে হয় নি, তুমি একজন ব্যর্থ লেখক? এই এতগুলো মানুষ, যাদের তুমি চেন না, তারা তোমাকে কেউ মাপছ না, অথচ তুমি তাদের মেপে যাচ্ছ। মাপলেও তুমি তাদের কিচ্ছু বুঝতে পারছ না। হায়, তুমি বোঝার চেষ্টা করছই বা কেন। তুমি তো বুঝতে পারবেও না। কারণ তুমি হাজার হাজার মাইলের ধুলো মেখে নেই। কয়েক হাজার বছরের ধুলো তোমার শরীরে, মনে , জামায়, ঘামে নেই। তোমার ঘাম দিয়ে বেরিয়ে আসে না সারাজীবনের লরি চালানোর ক্লান্তি। বিশ্বাস কর, তোমার মত দূরত্বের প্রতি তাদের প্রেম নেই। বরং তারা চায় রাস্তার ধারে কখন তাদের কেউ হাত ধরে বুকে টেনে নেবে। অথচ তোমার চোখ দিগন্তের দিকে। তুমি জানো, তোমাকে যেতে হবে। তুমি জানো, তোমার যাওয়া তো কেবল যাওয়া নয়, তুমি এ সব কিছুকে নিজের ঘামের মধ্যে নিতে নিতে চলেছ। তোমাকে যেতে হবে। আর তুমি বেরিয়ে আসবে সেই দিশি মদের ঠেক থেকে। সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে একটা মোগলাই পরোটা খাবে হয়ত। গাড়ির কাছে যাবে। জল দিয়ে নিজের মুখ পরিষ্কার করবে। অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে আরো একবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলবে। আর বলবে- রাস্তা যদি একবার ফুরিয়ে যায়, তাহলে পর্যটক করবে কী? সে কী গৃহস্থ হয়ে পড়বে তখন। গৃহ কী খোলা থাকবে তার জন্য? এই হল ক্লান্তি। এই ক্লান্তি একবার চলে এলেই কিন্তু মুশকিল। কারণ যত রাস্তাই তুমি অতিক্রম করো না কেন, আসলে তার পরের,তোমার না-যাওয়া যে কোনো রাস্তাই অচেনা। মনে রাখবে তোমার জীবনের শেষ রাস্তা কোনদিন আসবে না তোমার জ্ঞান থাকতে। এই ভেবে হেঁট।



এই যে এত জ্ঞান দিচ্ছি, তুমি কী ভাবছ, আমি সব জানি? না। কিছুই জানি না। আমি যদি সব জানব, তাহলে আর আমি পর্যটনে বেরিয়েছি কেন? আমি তো তোমার মতোই। ঘুরে বেড়াই। আর কিছুই করি না। আমার সঙ্গে তোমাদের দেখা হয়। তোমাদের সঙ্গে আমি রাস্তা হাঁটি। দেখি, আর ভুলে যাই। আবার দেখি। আমাদের সবাইকার আছে কিছু ছোট ছোট যাত্রাপথ। আমরা সবাই সে সব ছোট ছোট যাত্রাপথগুলির কথা একে অপরকে বলতে পারি মাত্র। আর কিছু নয়। আর সে সব যাত্রাপথগুলি যে সবার এক তা কিন্তু নয়। ধরো, কোনো এক বিশেষ রাস্তা। সেই রাস্তায় তুমি-আমি দুজনেই যাচ্ছি। দুজনেই যেতে যেতে লক্ষ করছি নানাকিছু। আমার মত করে তুমি দেখছ না। আবার তোমার মত করে আমিও দেখছি না। অথচ জানো, আমরা দুজনেই একই রাস্তাই দেখছি। আর হয়ত আমাদের অচেনা কেউ কেউ সেই রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরছে। সেও  তার মতো করেই দেখছে এই রাস্তাটিকে। তার মত করেই আবিষ্কার করছে রাস্তার দেবতা এবং ধূলিকণাগুলিকে। আবিষ্কার করছে অযাচিত সরাইখানার পাশে নির্জনে দাঁড়িয়ে থাকা বনস্পতির তলায় অগোছালো কুটিরখানি। আর মনে মনে ভাবছে, হয়ত এই কুটির আমার চেনা। কত কতদিন আগে এই কুটির আমি গড়ে তুলেছিলাম। কুটিরের পিছনেই আছে গাছের কোটর। কোটরে পা রাখলেই দেখা যায় সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গ চলে গেছে উনবিংশ শতাব্দির দিকে। হয়ত ভাবছে আমার মত দেখতে কেউ তার বন্ধু ছিল একদিন। আমাকে তার চেনা মনে হচ্ছে যখন আমি তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আমি যখন তাকে অতিক্রম করে বেরিয়ে যেতে যেতেও লক্ষ্য করছি না তাকে, সে হয়ত ভাবছে, এই যে এক মুহূর্তের জন্য দেখা হল, এও হয়ত এই রাস্তা তেমনটাই চায় বলে। আর এই যে আমি তার দিকে ফিরেও তাকালাম না, তাও হয়ত রাস্তাটা চায় না বলেই। আর দ্যাখো আমরা কেমন একে অপরের দিকে না তাকিয়েই ফিরে যাচ্ছি আমাদের রাস্তায়।

আর তার পর আমাদের দেখা হল। দেখা হল না বলে বলা ভাল খুঁজে পেলাম। তুমি ছিলে দূর এক শহরের মেয়ে। আমি ছিলাম সাধারণ এক ভ্রমণকারী। আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল না। আমরা ছিলাম নিজেদের নিজেদের নিজেদের মত রাস্তায়। দূরত্ব ছিল অনেক। তোমাদের অনেক পশ্চিমের আকাশে যখন সূর্য অস্ত যায়, আমাদের এখানে তখন অন্ধকার। তুমি আমার চেয়ে কিছু পরেই সূর্যকে দেখতে পাও। তবু আমাদের দেখা হল। আর আমরা বুঝতে পারলাম আমরা কেমন অপেক্ষা করেছিলাম একে অপরের জন্য। আর দ্যাখো, সমস্ত শীতের হাওয়া কেমন সরে গেল আমাদের জীবন থেক। কেমন মৃত্যুর আগে আমার কাছে চলে এল নতুন বসন্ত। আর আমি বেঁচে থাকতে শিখলাম। আমি আরো কয়েকদিন আরো কয়েক বছর এই পৃথিবীতে টিকে যেতে চাইলাম। আর তুমি আমার হাত ধরে বললে- এই হাত তুমি ছাড়বে না কখনো। আমরা আমাদের রাস্তার কথা বললাম না। আমরা চাইলাম না আমাদের নিজেদের মত করে কোনো দিগন্তের দিকে হেঁটে যেতে। মনে হল রাস্তাটি বড় সুন্দর। রাস্তাটি যেদিকে যেতে চাইছে, সেইদিকে চলে যাক। মনে হল, রাস্তা যদি কোথাও না যায়, তাহলেও হবে। আমরা বুঝতে পারলাম আস্তে আস্তে, যে, যদি আমরা নাই বা পারি সুদূরকে ছুঁতে, তাহলে নিকটের দিকে যাওয়াটাই ভাল। আমরা দূরত্বকে আর টের পেলাম না। মনে হল, আমাদের মধ্যে যতই দূরত্ব থাক না কেন, আমরা চলে এসেছি আমাদের খুব কাছে। আমরা একে অপরের কাছে চলে গেলাম। কিন্তু থেকে গেলাম দূরে। আমরা জানি আমাদের মধ্যে একটা সুদূরের রাস্তা চলে গেছে। কিন্তু এও জানি, সেই রাস্তাটির এক প্রান্ত আর আমার মধ্যে বা আমার কাছে থেকে যাওয়া এক প্রান্ত থেকে তার মধ্যে আছে এক নিকটের সম্পর্ক। এই যে মুহূর্তের মধ্যে এই দূরত্ব কমে গেল আমাদের মধ্যে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জার্নি আর আমাদের রাস্তাটির মধ্যে দিয়ে অপেক্ষার অভিযাত্রার কোনো প্রয়োজন রইল না। তুমি হয়ত ভাববে দূর তো দূর রইলই। কিন্তু আমি বলব, দূর  তো কাছে থাকলেও দূর থাকে। দূর তোমার কত কাছে, তার উপর নির্ভর করছে, দূরত্ব আসলে দূরত্ব কিনা।
কিন্তু সমস্যা হল, সবকিছুই তো দূরে সরে যাচ্ছে। এই ধরো,এই মহাজগতের সব কিছুই একে অপরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে প্রচণ্ড গতিবেগে। এমনকী শূন্যতাও সরে যাচ্ছে সে যেখানে ছিল, সেখান থেকে অনেক দূরে। আর দূরে সরে যাচ্ছে বলেই জন্ম নিচ্ছে শূন্যতা। তৈরি হচ্ছে মহাকাশ। তৈরি হচ্ছে তারা – ছায়াপথের মত আশ্চর্য সব কিছু। দূরে সরে যাওয়ার মানেই কী তবে জন্ম? জন্মের মানেই মৃত্যু? মৃত্যুর মানেই আরো জন্ম? তাহলে আমাদের সব কাছাকাছি আসা, কাছাকাছি থাকতে চাওয়ার আকুতি, ভালোবাসা, এ সব কিছুই তো দূরত্বের স্বভাব? একই দূরত্ব আমাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে দিচ্ছে, আবার একই দূরত্ব আমাদের মধ্যে বাড়িয়ে দিচ্ছে দূরত্ব। আর আমরা যত কাছাকাছি আসছি, আমাদের দূরত্বের মধ্যে মুহূর্তে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে সরে যাচ্ছে পৃথিবী। কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের আকাশগঙ্গা। এভাবে সেই মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে কত কিছু। আর জন্ম নিচ্ছে আমাদের মায়া, আমাদের স্নেহ, আমাদের সংসার। জন্ম নিচ্ছে, খেলছে, নিজেকে সাজিয়ে তুলছে, বলছে, এই সারা শূন্যতা আমি, বলছে এই পূর্ণতা, সেও আমি। আর সে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই সে কাছাকাছি চলে আসছে আরও। সমস্ত শূন্যতা জানে, সে আসলে মুহূর্ত মাত্র। মুহূর্তকে তার মতো দেখতে। এছাড়া মুহূর্তের আর কোনো ছায়া নেই।
তবে এও অনুমান মাত্র। বোধ নয়।

(ক্রমশ)


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...