Saturday 27 January 2018

কণিষ্ক ভট্টাচার্য


ধারাবাহিক গদ্য




                    জানলা

ইস্কুলে কোনও জানলা ছিল না।
ইস্কুলের ঘরগুলো ছিল খুব উঁচু উঁচু। তিনতলা বাড়ি অথচ সে পাঁচ ছতলার থেকেও উঁচু। সেই উঁচু উঁচু ঘরের ওপরে কড়িবরগা দেওয়া। সেই কড়িবরগা থেকে লোহার রড দিয়ে দিয়ে পাখা ঝোলানো। ইয়া বড়ো বড়ো ব্লেড। আর সেই ছাদের খানিক নিচে অবধি মোটা কাঠের দরজা। একজনের মাথায় একজন করে চারজন দাঁড়ালেও সেই দরজার মাথা ছোঁয়া যাবে না। এমনিতে সব ঘরে বোধহয় দুটো করে দরজা। পাশে বারান্দা। কোণার ঘরগুলোতে চারটে করে দরজাদুদিকে বারান্দা। সবুজ রং করা দরজা। খড়খড়ি দেওয়া। সেই খড়খড়ির হ্যান্ডেল কী মোটা। একহাতে ধরা যায় না। নিচে টেনে খড়খড়ি সোজাও করা যায় না। বন্ধই থাকে। নিচের দিকে কোনও খড়খড়ি ভাঙা থাকলে সেখানে পা দিয়ে ওঠে ছেলেরা। নটিবয় শুর মাথাটা আর কালো থাকে না। একসময় এসে ধূসর রং হয়ে যায় তার। খরখর করে ঢিলে লাঠি মারতে মারতে হাঁটতে গিয়ে। সিমেন্ট করা বারান্দাটা খুব স্লিপারি। ওখানে কাগজের বল বানিয়ে ফুটবল খেলা হয়। ক্লাসে কেউ না থাকলে। আর অনেক দূর থেকে ছুটে এসে হঠাত দাঁড়িয়ে পড়লে স্লিপ খেয়ে অনেকটা যাওয়া যায়। ক্লাসে এত বড়ো বড়ো দরজা যে জানলা নেই। কিন্তু জানলা যে নেই সেটা অনেকদিন খেয়ালই হয়নি ছেলেটার। দোতলার সামনের সিঁড়ির দিকের কোণার ঘরটায় বসলে সামনে মাঠ দেখা যায়। ওটা ওদের স্কুলের মাঠ। মাঠের ওপারে কলেজ। বড়ো হয়ে খুব ভালো ছেলেমেয়েরা ওই কলেজে পড়তে পারে। অবশ্য ওরাও টিফিনের সময় ঘুরে বেড়ায় ওই কলেজের মধ্যে দিয়ে। স্কুল আর কলেজের আলাদা গেট হলেও ভিতরে আলাদা নয়। দিব্যি ঘুরে বেড়ানো যায়। সকালে অবশ্য কলেজে কেউ থাকে না। ফাঁকা ওদের রাস্তাগুলো তখন। বন্ধ দরজা। আর ওদেরও কোনও জানলা নেই।
বারান্দায় দাঁড়ালে ওপারে কলেজ স্কোয়ার দেখা যায়। স্কুলে পনেরোই আগস্টের ফ্ল্যাগ তোলার দিন কলেজ স্কোয়ারে গেলে দেখা যায় বাঁশ পড়েছে ওখানে। আর পয়লা সেপ্টেম্বর তাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার সমাধিতে যায় ওরা স্কুল থেকে লাইন করে। সেদিন দেখে প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে। কলকাতার সবচেয়ে বড়ো পুজো তখন ছিল কলেজ স্কোয়ার আর মহম্মদ আলি পার্ক। সেই প্যান্ডেল আগে থেকেই দেখা হয়ে যেত ছেলেটির। আর দুটো প্যান্ডেলও দেখা হত আগে থেকেই। স্কুল থেকে হেঁটে ফেরার সময় ওই দুটো অবশ্য কালীপুজোর। ওই পুজো দুটোর নাম ছিল কী যেন, সম্ভবত তার একটা নবযুবক সংঘ। কিন্তু ওই দুটো পুজোকে লোকে চিনত ফাটাকেষ্ট আর সোমেন মিত্তিরের পুজো বলে। তবে ওই পুজোর প্যান্ডেল দিনের বেলা দেখে মজা নেই। ওর মজা আলোতে আর ভাসানের দিন রাত্তিরে আলোর গেটের প্রতিযোগিতায়। লোকে বলত এবার কী লাইট করেছে ওরা! এরা তো ফেল। যতই প্রতিযোগিতা থাকুক এই দুজন লোকের খুব বন্ধুত্ব ছিল। ছেলেটা স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখেছে এদের আমহার্স্ট স্ট্রিটে আড্ডা মারতে। তখন ওই দুজন খুব আলোচ্য লোক। একজনের পুজোয় একবার অমিতাভ বচ্চন এসেছিল। অমিতাভ বচ্চন সিনেমা করে। হেবি নাম। লোকে গুরু বলে। গুরুর মতন নিচটা ঢোলা প্যান্ট পরে। তাকে বেলবটম বলে। ওরাই সেই লোক। একজন সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর সাদা চটি আরেকজন সাদা শার্ট প্যান্ট আর সাদা চটি সম্ভবত। তেমন মনে নেই ছেলেটির। এই সাদা চটি ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগত ছেলেটির। খব অল্প কিছু লোকই পড়ত সাদা চটি। একদিন ছেলেটা বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে ফিরছিল। বন্ধুদের মায়েরাও হাঁটছিল পিছনে পিছনে। ছেলেটি ওদের দুজনকে বসে থাকতে দেখে তার বন্ধুকে বলে, ওটা কে জানিস? ওটা ফাটাকেষ্ট। এদিকে পাশের লোকটা তো শুনতে পেয়েছে কথাটা। উঠে এসেছে রক থেকে। এদিকে তো কালো হাপ্প্যান্ট আর সাদা জামা শিশু দুটি সেই উঠে আসা দেখে পেয়েছে বেজায় ভয়। ওমা, ওই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর সাদা চটি পরা লোকটা তাদের সামনে এসে কিনা হাঁটু মুড়ে তাদের সামনে বসে। টেনে চুল আঁচড়ানো, বড়ো বড়ো চোখ লোকটার। ছেলে দুটোর কালো হাপ্প্যান্ট প্রায় ভিজে যাওয়ার অবস্থা। অথচ লোকটা কী নরম গলায় বলে শোনো বাবা, ওঁকে কেষ্টকাকু বলবে। খারাপ নাম শুনলে তো ওর তো খারাপ লাগবে। ততক্ষণে মায়েরা এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। আরে এই লোকটাই তো সোমেন মিত্তির। যার অত্ত বড়ো পুজো হয়। তারপর থেকে ইস্কুল থেকে ফেরার সময় ওই দুজনকে দেখলে হাত নাড়ত ওই কালো হাপ্প্যান্ট আর সাদা জামা দুটো। লোকটাও হাত নাড়ত। 
কলেজ স্ট্রিট দিয়ে মিছিল গিয়েছিল। মিছিলের লোকেদের হাতে ছিল লাঠিসোটা, সাইকেলের চেন, হকিস্টিক, ভাঙা বোতল। মিছিলের স্লোগান ছিল, খুন কা বদলা খুন হ্যায় মার কা বদলা মার হ্যায়। প্রায় মুখোমুখি দুটো স্কুলের মাঝখানে কলেজ স্ট্রিট। দুই স্কুলে তার দুই দাদা পড়ত। যৌথ পরিবারে নিজের দাদা আর খুড়তুতো দাদার পার্থক্য ছিল না। দুই দাদাকে ওই দুর্বৃত্ত-দুর্যোগের শহরে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি পোঁছে দিয়েছিল কাকুরা। কাকুদের বইয়ের দোকান তাদের স্কুলের গেটের পাশে। স্কুল ছুটি হয়ে গেলে ওই দোকানে ঢুকে বসে মায়ের আসার অপেক্ষা করত ওরা। কাকুরা পরিবারের লোকের মতোই ছিল। ওদের পোঁছে দিয়ে তবে ফিরেছিল কাকুরা। মা স্কুলে আনতে গিয়ে শোনে ছেলেরা কাকুর সঙ্গে চলে গেছে। উদ্বিগ্ন হয়নি কিন্তু তাতে। বাড়িতে টিভি ছিল না তখন। রেডিওতে ঘোষণা হয় অনেক পড়ে। বাড়ির পাড়ার সবাই পাশের বাড়িতে টিভি দেখতে গেছিল। নীল প্রোটেক্টিভ গ্লাস লাগানো সাদাকালো টিভি। টিভিতে ওই নীল কাচ না লাগানো থাকলে চোখ খারাপ হয়। দাবানল শব্দটা সে বইতে পড়েছে কিন্তু সেটা কী রকম তা জানত না। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত খবর আর হিংসা ছড়াচ্ছিল সেদিন দাবানলের মতোসেদিন ৩১শে অক্টোবর। টিভিতে রেডিওতে ইংরেজি-বাংলার চেনা শব্দ অচেনা হয়ে উঠেছিল সেদিন। আর অচেনা ভাষা হিন্দির অচেনা অজানা শব্দে ছেয়ে ছিল সেই দিনটা। পরের দিন বাংলা বন্ধবাংলা বন্ধ ছিল এমন একটা চেনা শব্দ যেটা সেদিন নিশ্চিন্ত করেছিল অনেককে। দিল্লির খবর বলছিল অনেকে। সেখানে নাকি শিখ দেখলেই খুন করা হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে চুলদাড়ি কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। সদ্দার-গদ্দার বলে একটা নতুন শব্দ শিখেছিল তখন স্কুলের বন্ধুর থেকে সেদিন টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর দাহকাজের সময় একটা ইংরেজি কবিতা বলছিলেন ঘোষক। গলায় অদ্ভুত আবেদন। যেন কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। স্বচক্ষে সে হিমানীপ্রপাত দেখেনি কখনও, বাড়িঘর উড়িয়ে নেওয়া সাইক্লোন কিংবা মরুঝড়। ঘোষকের উচ্চারণে বিরাট কিছু একটা ক্রমাগত ভেঙে পড়ছে সে সরকারি স্কুলে ফাইভ পর্যন্ত ইংরেজি পড়েনিকিন্তু ঘোষকের বলাটা অনেক দিন মাথায় ছিল। অনেক পরে সেই কবিতাটা পাঠ্য বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কবিতাটি ছিল ক্রসিং দ্যা বার কবিতাটা পড়তে গেলেই সেই ভাঙনের গলাটা শুনতে পেত সে, অনেক দিন। কে সেই ঘোষক ছিলেন সে জানে না। বড়ো হয়েও তার মনে হয় যেন অমনই ছিল নিশ্চয়ই টেনিসনের গলা।
শব্দ, শব্দের ছবি, কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ মনের মধ্যে এক একটা জানলা খোলাবন্ধ করে। আলো আসে যায়। যে আলো ভেতরে যায় তা অনেক অনেক দিন খেলা করে ভেতরে। আরেকদিন দেখেছিল স্কুলের পিছনের সিমেন্টের মাঠে পোস্টার লিখছিল প্রেসিডেন্সির দাদাদিদিরা। তখনও টিফিন হয়নি। বারান্দার থেকে ঝুঁকে ওদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনছিল ছেলেরা। ওই দাদাদিদিদের কেউ কেউ চেনা। তারা মাঝে মাঝে রাজনীতির কথা বোঝায় এই ছেলেদের। ওদের কেউ কেউ তখনই সেই রাজনীতিতে খুব অ্যাকটিভ। বেশ কজন গোল হয়ে ঘিরে। সেই বৃত্তের মধ্যে সাদা কাগজে আগুন বুনে দিচ্ছে উবু হয়ে বসা থাকা তিন-চারজন। লাল আর কালো দুটো মাটির খুরিতে রঙ ওদের রাগের মতো নামছে খুরির গা গড়িয়ে সেই রাগের তুলি কাঁচিয়ে নিচ্ছিল ওরা। স্বাধীনতা তখনও পঁয়তাল্লিশের যৌবন ছেড়ে বছরের প্রৌঢ়ত্বে ঢুকছে আর ওই দাদাদিদিরা উনিশ থেকে একুশ যৌবন আর ওরা তেরো-চোদ্দ কৈশোর। অথচ ব্যর্থ ক্রোধের হতাশা সেই তেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ সকলকেই নাড়া দিচ্ছে। আসলে কদিন ধরেই খবরের কাগজে লেখালিখি চলছিল। টেনশন ছিল একটা। সত্যিই কি ওরা ভেঙে ফেলবে? সত্যিই এমন কিছু ঘটতে পারে! রাজ্যে রাজ্যে ইটপুজোর নামে অশান্তি ছড়াচ্ছিল আগে থেকেই। এমন কিছু শব্দ এসে যাচ্ছিল রোজকার কথাবার্তায় যেগুলো আগে কোনোদিন আসতে শোনেনি সে। আনাচ কানাচ থেকে চেনা শব্দ অচেনা হয়ে উঠে আসছিল সেই সময়। ওরা শব্দটা যে এতো আলাদা সেটা বাক্যরচনা লেখার সময় কোনও দিন মনে হয়নি তো। আলাদা শব্দটাও। কবেকার কোন নিভে যাওয়া ইতিহাস, কোন সীমানা পেরোনোর হাঁটা, কোন অত্যাচারের কাহিনি আবার নতুন করে তেল ঢেলে জ্বালানো হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে থাকা ছেলেদের সঙ্গে সেও শুনল মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সব খবর তখন সবাই জানে তবুও রেডিও টিভি নিশ্চুপ। সবাই বলছে বিবিসি নাকি লাইভ দেখিয়েছে। তার আগে অবধি বিবিসি বলতে রেডিও বুঝত সে। যেখানে কী সুন্দর বাংলায়ও খবর হয়। অনেক রাতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সে একটি নতুন ইংরেজি শব্দ শিখেছিল ডেমোলিশন তার পরের কয়েক দিনের কাগজে দেখেছিল শিলিউট একটা ছবি। মসজিদের ছাদের ওপরে বল্লম সড়কি হাতে মানুষ। পরে বোধহয় টিভি দেখিয়েছিল ভেঙে যাওয়ার পরের দৃশ্য। শিখেছিল দাঙ্গা শব্দটি খবরের কাগজে লেখা যায় না। সংঘর্ষ লিখতে হয়। কোন অচেনা অতীতের দাঙ্গার ইতিহাস খুঁড়ে তোলা হয়েছিল। সারা দেশের জেলবন্দী অপরাধীর পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো হয়েছিল ওরা অপরাধপ্রবণ জাত, ওরা দেশে সংখ্যায় কেমন বেড়ে যাচ্ছে, একদিন ওরা দেশটা দখল করে নেবে যিনি বলেছিলেন তিনি কলেজে দর্শনের শিক্ষক ছিলেন তারপরে কলকাতা পুলিশের বিরাট বড়োকর্তা। কত জানলা খোলা থাকলেও তার মনে আলো ঢোকেনি তেমন করে অথবা সে জানলায় শার্শি ছিল রঙিন। অথবা সব আলোই এক রঙের হয়ে ঢুকত। 
(ক্রমশ)


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...