দীর্ঘকবিতা
অসাড়লিপি
আবহ
পরপর নেমে আসছে অক্টোবর
নিচে গ্রাম দীর্ঘ নদী ও জাঙাল
অপেক্ষা ও চুপচাপ
শ্বাসরোধ ও মিলন
পরপর আকাশের শারদীয় লোভের মাংসের দিকে
মাথা ঘোরাচ্ছে
গ্রামের শিকড়, শরীর, সুর
রাস্তা উৎসব পানীয়হীনতা
তাদের উন্মুখ অস্তিত্ব মেলে ধরছে
আর তাদের মুখে নেমে আসছে
ছায়ামুক্ত অক্টোবরের মাংস
এই আমাদের বাংলা, অনভ্যস্ত অন্য ভাষার শব্দে
জেগে উঠেছে আবার, যদিও এখনও দু একটা পুরনো
বাক্যের মাংস লেগে আছে
স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে গ্রাম সমূহের উপড়ে আসার শব্দ
আশ্চর্য রোদের দিন, অব্যবহারে জীর্ণ বাক্য
অনভ্যস্ত ভাষায় বলা বিদায় বার্তা
পেরেকে গিঁথে রাখা ব্যাকরণের পাতা
উপড়ে আসছে বিকট ধাতব আওয়াজে
শোনা যাচ্ছে দিন ও বছরের উপড়ে আসার শব্দ
অসাড় এসে স্পর্শ করেছে সমগ্রতা
দেখা যাচ্ছে বিরাট একেকটা গ্রামের মাংস
বিরাট একেকটা নদীর শরীর
খাবলে নিচ্ছে মাংসাশী পাখিরা
স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল গ্রাম শহর অভ্যাস ও বিভাজন
তৈরি করা পাঠ্যসূচি ও অস্বীকার
বর্জন করা শব্দ ও আমার নিজস্বতা
নক্ষত্রের দিকে ঠায় চেয়ে থাকাগুলোর
উপড়ে আসা
শোনা গিয়েছিল সহস্র মাংসাশী পাখি যারা
আসলে অজস্র আকাশ ঠাসা একেকটা শ্মশান ও ভাগাড়
তুলে নিয়ে চলে গেছে আমাদের অবহেলার স্তূপ
আমাকেও কি নিয়ে গেছে? সমগ্র আকাশ গ্রাম গিলে
ফুলে থাকা এক সরীসৃপের পেট
নিচে পড়ে আছে আমার ভাষার খোলস অক্ষরবিহীন
৩
না, তুমি দেখতে পাওনি নাকি দেখতে চাওনি দীর্ঘ সজল বাগানের মধ্যে দিয়ে যে শরৎ বিকেল তার গায়ে জমা হচ্ছিল হিংসা, মাংস কাটা পর্যন্ত, চামড়ায় আঁচড়ের দাগ পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করে গেছ, নিজের ঠোঁটে ঝুলে থাকা রক্তের ডেলা, পেটে লুকনো বিবমিষা, ছড়িয়ে থাকা গা ঘিনঘিন গলির থকথকে মানব ও জান্তবের দিকে দেখতে চাও না তুমি, যে রাস্তা দীর্ঘ এবড়ো খেবড়ো বমি করে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, তীব্র হয়েছে মানব সংখ্যা – সহস্র জনস্রোত ক্রমাগত শহরে আসছে – তুমি তাদের সংখ্যা ভেবেছো, সামনে ঝকঝক করছে তোমার না দেখা আর তার ওপর অসাড় তার তোমাকে বশ করছে
আমি আমরা ক্রিয়াপদ
খাবার টেবিলে ছড়ানো
আমার ব্রাহ্মণ ভাষা
জানলা ও ভাষাবিজ্ঞানের রক্তে
প্রবাহিত চির-অব্রাহ্মণ দেশ কাচের টুকরো
ক
আমরা রক্তে অনুভূত কাচের পৃথিবী দূরে ঠেলে দিই
খ
আমরা অসাড়প্লাবিত টেবিল ও তার ব্রাহ্মণ ভাষাক্ষত্রের বুকে আরেকটু সময় নামক মোম রাখি, (তাতে কি উত্তাপ আসে?) এই অক্টোবর প্লাবিত দুনিয়ার রং পুরনো ব্যবহৃত মোমবাতি – আমরা অপেক্ষা করি
যাতে আমার মা তার অস্পষ্ট গর্ভ নিয়ে এখানে সামান্য ব্রীড়ায় বাবার সামনে দাঁড়ায় যাতে আরেকবার তলপেটে লাথি ও ভাষার শরীরে আরেকটা সংখ্যা ছড়িয়ে যায়
গ
এই বিস্তৃত ভাষাক্ষেত্রের সামনে মা ও তার গর্ভ আসলে এক গোপন দেশ। আমি এক কাঠের টেবিলে ব্যাপ্ত মোমের আলো
ঘ
আমি আর সময় ক্রমাগত ভেসে যেতে থাকি, আমি আর আমার মায়ের ব্রীড়া দুজনে মিলে মায়ের অযৌনতায় ধাক্কা দিতে থাকি, এভাবেই আরেকপ্রস্থ ভাষা ছড়িয়ে পড়ল বাদামি ফোঁটায়, ডাক্তারের অ্যাপ্রনে
ভারি শব্দের পেরেক গেঁথা ভাষা
অভিধানে না ওঠা চলিত অর্থ
রক্তে বহন করা দৃশ্য-টুকরো
আবেগ ভাসিয়ে রাখা রচনাশৈলীর ফাতনা
তুমি জানতে কীভাবে স্বপ্নের ভিতরে নীল একটুকরো নদীখাতের উপলখণ্ড রেখে আসতে হয়। আমার বাঁচা ফিসফাসের মধ্যে টানটান এক নৌকার পালের মত, আমি জানি এই আগুন সমুদ্র থেকে কোনও পশু কেউ তুলে আনবে না আমাদের শান্ত চাউনিতে ঝলসে নেবার জন্য – অথচ আমি তোমাকে বাধ্য করব এই দেশ, শহর ও বিস্ফার – এই প্রবণতাহীন হত্যানন্দে যে বালক স্তব্ধ পোশাকের নন্দন রেখে যাচ্ছে, আমি জানি তার সামনে এই বিকেল ওপচানো সন্ধেগুলো কোনও উপহার নয়। প্রতিহত যে দরজা তোমার সামনে তাকে আমি নিপুন বন্ধ বলে ডাকছি – তোমার স্বর ভারি পদক্ষেপে কেঁপে ওঠা কোনও বিস্মৃত গভীর জল, আমি তার সামনে ক্ষয়ে আসা এক প্রতিরোধ। এই শ্মশানদীর্ঘ চলার সামনে যতগুলো পোড়া বসবাস ও চলন তাদের মধ্যে ঈশ্বরগন্ধী পাথর, যৌন স্যাঁতসেঁতে অগাস্ট-শ্যাওলা – আমরা নীচু হয়েছি, তুমি আঙুলে তুলেছো ভিজে গাঢ় ছাই রং, এরপর শুধুই পশুভ্রূণ-কুঁকড়ে থাকা আর কিছু নেই অসাড় অসাড় ক্রমশ মেলে দিয়েছে রঙিন সামিয়ানা। গোটা শহর বয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে পোকা আনতে, অথচ আমার তেমন কিছু নেই, বন্ধুরা বিশ্বাস করতে চাইবেনা এই দৃশ্য, শুধু তীব্র অসাড়ের জ্যোতিপ্রকাশের মধ্যে শরীর জুড়ে বেড়ে ওঠা জ্বর ও বমিভাব লুকিয়ে দেখতে পাচ্ছি ভিজে ছাইয়ের দাগ ধরে ঘসটে চলে গেছে আমাদের ভাষা, আমরা স্বীকৃতি দিইনি দূরের লেখা।
আমাদের স্তব্ধতা ও বিরোধের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছে এই সময়ের কন্দমূল, আমরা সব ভুলে থাকার চেষ্টায় ফুটিয়ে তুলেছি মাটির বিকৃত মুখোশ – যেন অন্য কেউ নজর না দিতে পারে – আর যে শিশুটি ধুলো তার মাঠ বরাবর মেলে দিচ্ছি অতীত রঙের আশ্বিন, যাকে মায়াবী নাম দিয়ে বাংলার আয়নায় ঠেসে দিয়েছি আমরা। সেই আয়না আমাদের নিয়ে ফেলছে পরপর মানুষ ও বসতি ঠিকরে দেওয়া সর্পিল রাস্তা যাকে পথ বলে ডাকতেই মসৃণ হয়ে যায় গাঢ় কালিতে লেখা পুরনো পোস্টকার্ড – বন্যা বা সন্তান জন্মের খবর। একগুচ্ছ মরা পাতার মধ্যে দিয়ে শামুক রঙের বিকেল, তার শরীরের গন্ধ মিশিয়ে দিচ্ছি চিৎকারে যা এতদিন কাচের জানলায় বাষ্প হয়ে ছিল।
যখন অসাড় ওঠে এই দৃশ্যসমূহের ওপর, আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি উঁচু এক বাড়ির ছাদে, আমার অন্তরতম ভয় আমাকে ধর্মের ঘন্টাধ্বনি শোনাচ্ছে, আর ছিটকে উঠছে রাস্তার স্পিডব্রেকারে কোনও তরুণ যুগল, মেয়েটার বুক ঘষটা লাগলেও গতির শরীরে কোনও যৌনতা থাকে না – আমরা পরপর ভেসে যেতে থাকি, ঠিকরে উঠতে থাকি জনপ্রিয় গানের পরিধিতে। আমরা স্পষ্ট দেখি কীভাবে ইঁদুর ঢুকে তছনছ করে দিচ্ছে আমার কাঠের মস্তিষ্ক, চুপ করে দেখে যাব যেভাবে জীবনী আমার মধ্যে চালান করে দিয়েছিল শেষ ট্রেন ঢোকার আগে বালিগঞ্জ স্টেশানের অন্ধ ভিখারিদের খাওয়া বা সকালের শহরগামী এক ট্রেনের শিশু শ্রমিকে ঠাসা কামরা।
আমি জটিল কল্পনায় ঢুকে যাওয়া আমার জীবনেরই অংশমাত্র। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমার সামনে যে ভূখণ্ড তা কোনওভাবেই কোনও শূন্য থেকে শুরু করা ভাগ্যবিজয়ীর নয়। অথচ সেভাবেই কেউ তলিয়ে যাচ্ছে পোষা গুন্ডা, ফ্লাইওভার, বস্তি ও কংক্রিটের গলিতে চলা গুলির শব্দে, এবড়ো খেবড়ো ভাষাবিন্যাসের মধ্যে এই চিরশান্তির দেশ, এই শান্তিপূর্ণ, শান্তিময়, শান্তিরঞ্জিত দেবশঙ্কুল দেশে প্রতি ঘরে অন্ততঃ একবার ধর্ষণ হয়েছে; প্রতিটা শহর যখন নিজস্ব ঘায়ের ওপর অসাড় করে দেওয়া সিনেমার প্রলেপ লাগায়; প্রতিটা ফ্লাইওভারের নিচে কাদা রঙের খাবারের উপরে ক্ষুধার্ত দাঁত, ভোরের মুখে হিংস্র যৌনমিলন, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, আমার কিস্যু করার নেই ভেবে গোষ্ঠী নামক শব্দটাকে ব্লেড দিয়ে কাটি অভিধানে। উপর থেকে দেখি প্রবাহ বা সময়ের অন্যান্য চিহ্নের গায়ে আমাদের ছায়া ঘষছে, ছায়া ও তার উড়িয়ে চলা ধুলোয় কোনও দেশ গাঁথা নেই।
বারবার বলছি সরে আসার কথা, আমার ভাষা ও স্তব্ধতা, সমস্ত রকমের মাংসল কামড় যেখানে উগরে দিয়েছে সহজাত, উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর ছড়িয়ে থেকেছে হজম না হওয়া খাবারের দুর্গন্ধ নিয়ে আমার চাতুর্য। ভাষা ও দেশজ শব্দের মধ্যেকার ব্রাহ্মণ্য দূরত্বকে অস্বীকার করার মত সজোরে গিলে নিচ্ছি আমার ইচ্ছে, বলছি হ্যাঁ আমার প্রতিটা জনপ্রিয় গানের লিরিক লিখতে ইচ্ছে করে, হ্যাঁ স্তনসন্ধির লোভই আমার মাংসল আত্মা আর তোমরা মেতে উঠছো উৎসবের সহজে, চেটে চলেছো উৎসবের সাদা আলোর গুঁড়ো, নিশ্বাসে টানছো তাকে, টেবিল থেকে সারিবদ্ধ সাদা গুঁড়ো
ছায়ার মাতৃভাষা এই থেমে থাকা। আমার প্রতিটা চিন্তাসূত্রের পিছনে একটা শীর্ণ নদী, গ্রামহীন বসতিহীন কিছু চিন্তাস্রোত, যাদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি শ্রেণী বিভাজনে, প্রতিনিয়ত বিভেদরেখা আমাকে নিয়ে ফেলেছে দর্শকের ভূমিকায়, অথবা সন্ধানী খাতায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে – আমি সেই দূরত্বের ধাতব গন্ধ চুষে নিই; ভাবি কীকরে চলে গেল আমার ভাষা, আর এখানেই ভেঙে আসে আমার অস্তিত্ব আমি চিৎকার করে বলতে চাই আমার ভাষা বলে কি কিছু বাকি নেই; আমার শরীরে শুধু ছড়িয়ে রয়েছে বহনের চিহ্ন, আঁচড় ও ভারি হয়ে থাকা থকথকে প্রতীক্ষাপুঞ্জ, হাঁ-মুখ, কাঠবাদামের গাছ, শরৎ ও উগ্র অসাড়
সমসময়ের অসাড়তাকে কবিতায় ধরার কাজটা সহজ নয়, কেননা, সামান্য প্ররোচনায় তা স্লোগান অথবা উচ্চকিত বক্তৃতা হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু এই দীর্ঘকবিতায় (এর আরেকটা অংশ আগে পড়েছিলাম), এই অস্পষ্ট সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে একজন মানুষের যন্ত্রণা, অসহায়তা ও ক্ষোভ, যথার্থ কবিতার আধারে ধরা দিয়েছে বলেই আমার মনে হয়।
ReplyDeletethank you Souva
Delete