Saturday 27 January 2018

যশোধরা রায়চৌধুরী






আলোবাতাসা

দিদার বাড়িতে জানালাগুলো ছিল ওপর থেকে নিচে লম্বা লম্বা। এক একটা জানালায় দু ভাগ। কোমরের কাছে কাঠের মোটা বাঁধন আড়াআড়ি। ওপরে শিক, নিচে শিক সব কাঠের আর সব গাঢ় সবুজ রঙের। আর সেই সবুজ রঙা কাঠের পাল্লা, কাঠের খড়খড়িগুলো ফাঁক করা যায়। ওপরে নিচে। খটখট খট। তুলিরা ওটাই খেলত।

ঝড় ঝড় খেলা। সারা ঘরে আলো আঁধারি, বিদ্যুতের চমক তৈরি হত দুপুর বেলায় কাঠের খড়খড়ি খুলে বন্ধ করে। আর সেই ঝন ঝন আওয়াজ। কী চমৎকার ঝড় তৈরি করত তুলি, মাতু, হালুম সবাই। দাদা দিদিরা অন্য ঘরে ধাঁধার খেলা খেলছে, মজার গল্প, ছড়া। হিন্দি সিনেমার গান। আর তুলিরা এইঘরে ঝড় ঝড় খেলছে।

তুলি শুনেছিল, মা বলেছিল, ওই ঘরে আলোবাতাসা আসে   আলো দিয়ে তৈরি বাতাসা। বাতাসা গোল গোল, মিষটি মিষ্টি। দারুণ মজা , মুখে দিলেই কেমন গলে যায়। তুলির ভাল লাগে বাতাসা খেতে। তবে আলোর বাতাসা আরো সুন্দর। যেসব দিনে মামাতো ভাইবোনরা থাকেনা। একা একা দিদুর একটা মোটা বই নিয়ে পড়ে। কাশীদাসী মহাভারতের পাতায় পাতায় কত ছবি। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও। পড়তে পড়তে ছবি দেখতে ভাল লাগে। ছবিতে গাছপালা, রাম সীতা, আর পেছনে আকাশ, আকাশে বেগনে রঙের মেঘ। মন কোথায় হারিয়ে যায়।

গ্রীষ্মের দুপুর। মা, দিদা সব ভোঁস ভোঁস ঘুম দিচ্ছে। সেই সময় এইসব বই পড়া আর বন্ধ খড়খড়ির ফাঁক থেকে আসা ধুলোর সুতো দেখা। সাদা ধবধবে লাইন টানা আলো এসে পড়ে, সেই আলোর মধ্যে ধুলো উড়তে থাকে। সাদা সাদা কণা। আর , মেঝেতে এসে পড়ে গোল গোল আলোবাতাসা। যত বেলা বাড়ে, তত সেই মেঝেতে পড়া বাতাসাগুলো ঠাঁইবদল করতে থাকে। ঠিক যেন কেউ লুডোর গুটি সাজাচ্ছে। এই ছিল এখানে, দেখ না দেখ চলে গেল ওইদিকে। কী মজার। আর, আলোবাতাসা হাত দিয়ে চেপে ধরতে ইচ্ছে করলেও ধরা যায় না। হাতের পাতা দিয়ে চেপে দিলেও আলোবাতাসা লাফিয়ে হাতের ওপরে উঠে পড়ে। তালুর তলায় চাপলে হাতের পাতার পেছনে চলে যায়। ব্যাঙ নাকি? লাফায় কেন এত?

বড় হয়ে তুলি জানতে পেরেছে আলোবাতাসা বলে কিছু নেই। তুলি ভুল শুনেছিল, মা বোধ হয় বলেছিল আলোবাতাস।


বাতাসা আজকাল আর কেউ খায়না।

মরুভূমির রঙ



মারু বিহাগ। চালাতেই চোখের ওপর সারি সারি ছবি। আমি মরুভূমির দেশে এসে রঙ খুঁজেছি খুব। পেয়েছি রঙ্গিন মানুষ। 
রোদ্দুরে পুড়ে যাচ্ছে দিগবিদিক। লালচে, রাঙা মাটি, ধুলোর ওপর দিয়ে রোদ চড়ছে, কমলা হলুদ রঙ্গের রোদ। গলি, রাস্তা, ছোট শহর, খুব ছোট ছোট দোকান, সামনেটা তেরপল দিয়ে ঢাকা। এই কসবাটার নাম রুদ্রপুর। পাহাড়ি, কাটাকাটা পাথরের উচ্চাবচ্চ অবতলের মধ্যে একটু নিচু আর ছায়ায় একটেরে জায়গায় বসানো। জনবসতি গড়ে উঠেছে আস্তে ধীরে, কয়েকশো বছর ধরে। আর সেই পুরনো জঞ্জাল, পুরনো রোদ্দুরখাওয়া জংলা জমি, পুরনো সব ঘরদোরের মাঝে মাঝে নতুন লাল টুকটুকে মোবাইল কোম্পানির সেলস কাউন্টার গজিয়েছে। 
রোদ্দুরে পুড়ে যাচ্ছে অবয়ব। রোদ্দুর ঝলসে দিচ্ছে। ফুলিয়ে দিয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে। শক্ত, কর্কশ দিনগুলো, পাথরের চৌকোনার ওপর পড়েই চৌচির হয়, ঠিকরে যায় হিরের মত রোদের কুচি। আলো, সাগ্নিক আলো।
পলায়ন ভাল, কিন্তু রোদ্দুরে পোড়া তামাটে দীর্ঘদেহী অদ্ভুত দড়িপাকানো মানুষগুলোর ভেতরে অনেকেই আছে যারা শ্রবণ জানে না।  যারা হেঁটে যায় কয়েক কিলো ওজনের লাল বা গোলাপি পাগড়ির তলায়। মারু মহাগিরিজি। 
এই অশ্রবণের, অশ্রাবণের দেশে , মরুর দেশে শুধু শ্বেত ও পিঙ্গল বালুরাশিই আমাকে ধারণ করে তারপর। আর ওই রঙ্গিন মানুষেরা। 

এসো, সরবত ঢেলে দাও গেলাসে। গান শুরু হোক।




3 comments:

  1. "মারু বেহাগ" এর রেশ থেকে যাবে বহুকাল। যশোধরা রায়চৌধুরীর আরও লেখা চাই আবহমানে।

    ReplyDelete
  2. আলোবাতাসা আমার অসাধারণ লাগল দিদি।

    ReplyDelete

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...