Sunday 28 January 2018

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য


ধারাবাহিক গদ্য




'আমাকে কি খুব উদ্ভট দেখায়, বন্ধু?'

প্রশ্নটা করেই একদম চুপ করে যায় গোপাল। চুপ করে থাকে সেলুনের বাকি
সবাইও। কাগজে পড়ছিলাম তখন একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর।
রোববারের সেলুনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ওর পুরনো 'আমি'-টি তার
ভিতরের সমস্ত রোমাঞ্চ নিয়ে নতুন 'আমি'-র রহস্যজগতের উদ্দেশেই প্রশ্নটা
ছুঁড়ে দেয় যেন। তারপর হেসে ফেলে। সে হাসির দিকে তাকালে মনে হয়, মুখের
কলকবজাগুলো ফট করে খুলে গিয়ে একফোঁটা নরক বেরিয়ে এল। গোটা মুখে ফুটো
ফুটো দাগ। ওখানে ভালো করে বীজ পুঁতে দিলে কয়েকদিন বাদে পুরুষ্টু ধানের
গোছা বেরিয়ে আসবে। জটিলতর খাঁচার মধ্যে ঢুকে থাকা দুর্বোধ্য তেলতেলে
মুখটি নিয়ে গোপাল হাসতে থাকে। ওকে কেউই তেমন পাত্তা দেয় না। বহু পুরনো
এবং বেঢপ বুটজুতো পরে ধুলো উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় রাস্তা দিয়ে। ও কী করে,
তা কেউ জানে না। কোথায় থাকে, তাও জানে না কেউ। সারাদিন এই সেলুন এবং তার সংলগ্ন দোকানগুলোতে ঘোরাফেরা করে। পচা জলের পাঁকের মধ্যে কাঁকড়া বা মাছ যেমনভাবে বজবজ
  শব্দ করে বুদবুদ তোলে, অনেকটা ওরকমই একটি শব্দ ও করার চেষ্টা করে মুখ দিয়ে। দেখলে বোঝা যায়, ওর কিছু নেই। কোনও প্রত্যাশা
নেই। কোনও অভাবিত আনন্দ নেই। কোনও প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা নেই। যা আছে, তা
কেবল এই প্রশ্নটিই। প্রতি রোববার সেলুনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই
প্রশ্নটি সে আসলে যেন নিজেকেই করে। তারপর হাসে। গোপাল হাসে। ক্ষিতি, অপ,
তেজও হাসে। মানুষ কেবল হাসে না। তারা জানে, ও অপ্রকৃতিস্থ। এমন সব কথা সে
বলতে থাকে যার কোনও অর্থ নেই এবং আবেগের দ্বারা প্রবলভাবে স্পর্শিত না
হলে সেই সব কথায় এমনকি একটা সময় পর হাস্যোদ্রেকও হয় না।

'আমাকে কি খুব উদ্ভট দেখায় বন্ধু?'- প্রশ্নটা সে আরেকবার করে। এই
প্রশ্নটি কেন করে সে? তার মতোই কোনও অপ্রকৃতিস্থর সঙ্গে দেখা করতে যায়
কি আজ? প্রতি রোববার? নাকি, নিজেকেই বলে এমনি? দুপুরের সেলুনের শীত শীত
আলোর মধ্যে তা ক্রমাগত পাক খেতে থাকে তারপর। জ্বলো বাতাসের মতো ঘুরে ঘুরে আসে। হাতুড়ির মতো আঘাত করে ঠাস ঠাস করে। প্রতি রোববার সেলুনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করার পর গোপালের মুখ দেখলে মনে হয়, ওর ভিতরটা বোঝাই হয়ে ছিল বহুদিন। বোঝার ভারে রক্ত এসে গিয়েছিল মুখে।
  প্রশ্নটা
করার সময় যেন শিরা ছিঁড়ে পড়ে এবং নিজেকে সে একটু একটু করে ভারমুক্ত
করে, খালাস করে দেয় সমস্ত বোঝা।

প্রশ্নটি একসময় ঝট করে বেরিয়ে যায় সেলুন থেকে। লরির চাকায় ধুলো ওঠে
রাস্তায়। সেই ধুলোর মধ্যে নিরুত্তেজ প্রশ্নটিকে নিয়ে মিশতে মিশতে আরও
একটি বড়ো ধুলোর দিকে চলে যায় গোপাল।

খবরের কাগজ থেকে অল্প মুখ তুলে আড়চোখে তাকিয়ে তারপর দেখি, আমার পাশে
বসে থাকা আরও তিনজন মৃত মানুষও ভিন্ন কাগজ থেকে একই খবর পড়ে চলেছে মন দিয়ে।



No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...