Saturday 27 January 2018

শাশ্বতী সান্যাল


ঘুমপাড়ানিয়া এবং... 

একটা গল্পে কী থাকে? শুধু কতগুলো মুখের খসড়া... হ্যাঁ, খসড়াই। পান্ডুলিপি তৈরী হওয়ার জন্য বহু পথ ডিঙোতে হয়। পিচ্ছিল আধিভৌতিক সেই পথের বাঁকে বাঁকে লেগে থাকে বিচ্ছেদ, বলিরেখা,  কোঁচকানো চামড়া, হেলে যাওয়া হেমন্তের রোদ।  বন্ধুর অংশটুকু পার করে এসে আজ আমার খসড়া জানতে পেরেছে, আসলে জন্মকথায় কোনো গল্প লুকিয়ে নেই। গল্প যা সব লেগে আছে সেই ঘুমহীন রাতগুলোয় পাতায়। পৃষ্ঠাসংখ্যা আর মনে নেই, মনে রাখা সম্ভবও না। শুধু বিবর্ণ খন্ড খন্ড সেই শৈশব কৈশোর হাতড়াতে গেলে আজন্মের ঘুম যেন ছুটে আসতে চায়, গ্রাস করে নিতে চায় কনীনিকার আলো...



আজ বুঝি ঘুম বড় দুর্লভ আগুন
সকলে তা কিনতে পারেনা। আজ বুঝি ঠাকুর্দা ভুল বলেছেন আজীবন,
আমার জন্ম কোনো দৈববাণী উপলক্ষে নয়
জন্মকথা লেখা থাকে স্কুলপাঠ্য জীবনবিজ্ঞানে...

      বিদিশাদি জীবনবিজ্ঞান পড়াতেন। পরে সুপ্তি দি, আর একটু বড় ক্লাসে যখন। ব্যাঙের ডিসেকশন চলছে... পার্টনার পেয়েছিলাম ভাগ্যগুণে। সেইই শুরু থেকে শেষ অব্দি সবটা দায়িত্ব সহকারে করে দিত। আমার কাজ ছিল শুধু ট্রে'র জলটুকু ড্রেইন করা। কিন্তু কী দুর্ভোগ, সেদিন পার্টনারের দাদার বিয়ে, আমি প্র্যাকটিকাল রুমে একটা মরা ব্যাঙ আর একটা জলভর্তি ট্রের সামনে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছি। সুপ্তিদি ঢুকলেন, এক নজরে অভিজ্ঞ চোখ ফাঁকিবাজ ছাত্রী চিনতে ভুল করেনি। এগিয়ে এসে বললেন, আর যাই কর, ডাক্তারি পড়ার ভুল এ জম্মে কোরোনা যেন। কিন্তু ভুল কী কেউ জেনে বুঝে করে! ভুল হয়ে যায়। বছর ঘোরে। গ্রীষ্ম পেরিয়ে, বর্ষা পেরিয়ে, হেমন্তের রোদ আবার পশ্চিমে হেলে যায়। দূরে মানবেন্দ্র গেয়ে ওঠেন "বরষায় ফুটলো না বকুল, পৌষে ফুটবে কী সে ফুল?" না, বকুল ফোটেনি। সেটা ছিল পুরুষ গাছ, স্বভাবতই ফুল ধরেনি। শুধু শিকড় চলে গেছিল গভীরে। টেনে তুলতেই সে কী রক্ত... ব্যাঙের ডিসেকশনে ভুল করে শিরা কেটে দিলে যেমন ট্রে'র জল লাল হয়ে যায়, তেমনি লাল জল চারদিকে? লাল। লাল কি? আমি তো ডাক্তার হইনি সুপ্তাদি। নিছক ফুল ফোটাতে চেয়েছিলাম। হোক দেরীতে, তবু ফুলই তো... নরম- ছোট্ট- সাদা- সুগন্ধি... আসলে বিশ্বাস তো একটা জামা, যা অতিব্যবহারে ছিঁড়ে যায়। আর তখনই হেমন্ত পেরিয়ে আমাদের গল্পে শীত ঢুকে আসে- বরফের কুঁচি ঝরে পড়ে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়...

   ঘুম আসতো না বলে দীর্ঘদিন সূর্যোদয় অব্দি অপেক্ষা করতাম। সূর্য উঠলে তিনি উঠতেন। শুরু হত চণ্ডীপাঠ। আর আমি ঘুমোতে যেতাম সেই মন্ত্রের আশ্রয়ে। মানুষটার মুখের অজস্র বলিরেখায় বয়ে চলতো পদ্মা, মেঘনা। খুব মৃদু গলায় মা'কে প্রশ্ন করতেন-
 " ছোটোমা, কালিতারা ঘুমিয়েছে?"

    'কালিতারা'... অদ্ভুত নাম না? এই নামের পিছনেও আসলে একটা ঘুম আছে। একটা স্বপ্ন। যে স্বপ্নে একটা শ্যামলা বালিকা এক বিরাটদর্শন পুরুষের জামার খুঁট চেপে ধরে, আর বলে 'তোমার বাড়ি গেলে আগলে রাখবে তো?'........  হ্যাঁ, আজীবন আগলে রেখেছিলেন তিনি তাঁর কালিতারা'কে।  তাঁর বংশের নারীপ্রতিমাটিকে... যে না কী অভিশাপ বিদীর্ণ করতে জন্মেছে। বড় হওয়ার পর এক একসময় রাগ হত, অতিরিক্ত স্নেহ আর শঙ্কায় বিরক্তি আসতো... কিন্তু কোনোভাবেই দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত করা যায়নি মানুষটিকে... যে জীবনের গল্প শুরু হয়েছিলো পদ্মার তীরে, এক ছোট্ট অভিজাত বাড়ির বড়ছেলে আর মেছুরে প্রজাদের বাবাঠাকুর সেজে, সে গল্প শেষ হল সম্পূর্ণ অন্য দেশে, অন্য ভূখন্ডে, অন্য উদাসীনতায়... যেখানে তার পূর্বাশ্রমের কথা কেউ জানলো না। কেউ জিজ্ঞেস করলো না।

   একটা গল্পে কী থাকে? লম্বা টানা বারান্দা, যার যেটুকু জুড়ে রোদের আধিপত্য সেটুকু জুড়ে বসে থাকা একটা শরীর, একটা লাঠি, একটা কুঁচকে যাওয়া হাত আর অনেক উপকাহিনী। উত্তরের বাতাস দিলেই সেই রোদ আরো কমে আসে, সেই লোক আরো শীর্ণ হয়, আরো ছোট্ট হয়ে আসে, দমকে দমকে কাশি, শ্লেষ্মা।  পদ্মাপারের সব রাজরক্ত যেন উঠে আসতে চায় শিরা বেয়ে। পাশে বসে থাকা কিশোরী মেয়েটি, বহুদিন মেয়ে না জন্মানো অভিশপ্ত রাজবংশের একমাত্র কিশোরী মেয়েটি ফুল ঝরে যেতে দেখে... শৈশবের সুগন্ধী ফুল।

  না, গল্প আমি লিখতে পারিনি কখনো।  এযাবৎ যা লিখেছি সে সবই গল্পের খসড়া...

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব...